জানুয়ারির শীতের প্রহরে বাংলার আকাশে বাতাসে দুটি বিশেষ শব্দ ঘনীভূত হয়ে ওঠে। শব্দ দুটি অতি পরিচিত এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন–স্বামীজী এবং নেতাজী।
অনেকে মনে করেন বাংলা বাঙালি পরিবেশ ও চরিত্র গঠনে এ দুটি মানুষকে অনুসরণ করলেই বাঙালিত্বের জাগরণ ঘটে যায়।

স্বামীজীর জন্ম দিবস ১২ জানুয়ারি। নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত হয়ে গেল নরেন। রামকৃষ্ণদেব ডকতেন লরেন। নাম রাখা হয়েছিল বীরেশ্বর। বোধ করি তার থেকে হয়ে গেল বিলে। বীরেশ্বর মহাদেবের অপর নাম। নটরাজ শিবের আশীর্বাদে নাকি তিনি জন্মেছিলেন। বীরেশ্বর মানে কি? যিনি বীর তিনিই ঈশ্বর! বীর ও ঈশ্বর অথবা বীরেদের ঈশ্বর যিনি! এসবই আমার ভাবনা। তার নামের সঙ্গে বীরেশ্বর, বীর সন্ন্যাসী যুক্ত করা হয় এবং তার বিবেকানন্দ নামটি আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেয়ে গিয়েছে। নরেন্দ্রনাথ দত্ত সত্যিই কি বীর বা ঈশ্বর ছিলেন? বিশ্ব পরিভ্রমণ করে বীরত্ব দেখিয়েছিলেন, মানুষের কাছে গিয়েছিলেন। শিকাগোতে ধর্ম মহাসম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধি ছিলেন। ভারতকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিশ্চিতভাবে তিনি‌ সেই বীরত্ব দেখিয়েছিলেন। তিনি কি ঈশ্বর ছিলেন? তবে বাকবৈদগ্ধ্যে তিনি ছিলেন ঐশ্বর্যবান।কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি বিতর্কিত এবং দ্বিচারিতামূলক হলেও তাতে কিছু ঐশ্বর্যের সন্ধান নিশ্চিত পাওয়া গিয়েছে।

সন্ন্যাসী কাকে বলে? সাধারণত সংসার ত্যাগী মানুষকে, সংসারে বৈরাগ্য আছে এমন মানুষকেই আমরা সন্ন্যাসী বলে থাকি। সন্ন্যাসী কথার অর্থ সম্যকভাবে নিঃশেষে ছুড়ে ফেলার ক্ষমতা যার আছে তিনিই সন্ন্যাসী। আসলে তিনি কি ছুড়ে ফেলেন বা সম্পূর্ণরূপে কি কি জিনিস নিচে স্থাপন করেন? একটি ব্যাপক অর্থ রয়েছে এতে। নিজের স্বার্থ সর্বস্ব
যে প্রবৃত্তিগুলি মানুষকে জাগতিকভাবে আবদ্ধ করে রাখে সেগুলি পরিত্যাগ করতে পারেন সন্ন্যাসী। সমভাবে পরিশুদ্ধ মানুষই সন্ন্যাসী।

এখন বিবেকানন্দের জন্মদিবস বিবেক দিবস, যুব দিবস হিসাবে পরিচিতি পেয়ে গিয়েছে।কেন বিবেক দিবস? বিবেক কি? আসলে বিবেক ভাববাচ্য বিশেষ্য। এটি হৃদয়েরগত চেতনার জাগরণ এবং বোধি বোধ। বিবেকে আনন্দ যাহার তিনিই বিবেকানন্দ। আনন্দ সার্বজনীন।

অদ্ভুত আচরণ রাষ্ট্রের যে রাষ্ট্রের বিবেকবোধ নেই, যে রাষ্ট্রের যুব প্রগতির দিকে কোনও পরিকল্পনা নেই তারাই পালন করছে যুব দিবস, বিবেক দিবস!
প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বঞ্চিত করে দুর্নীতির আধারে নিজেদের আবদ্ধ রেখে কোটি কোটি টাকার পাহাড় বানিয়ে শিক্ষা চেতনার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটিয়ে যারা রাজ্য শাসন করছে যাদের বিবেকবোধ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত তারাই আজ পালন করছে বিবেক দিবস, যুব দিবস। আসলে তারা বিবেকানন্দকে, তার চিন্তা চেতনাকে কলঙ্কিত করছে, এই উৎসবের মাধ্যমে। বিবেকানন্দ এক্ষেত্রে ভোটের পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন। এসব উৎসব একটা একটা লোক দেখানো সার্কাসে পরিণত হয়েছে।

১৮৯৩ সালে ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে বিবেকানন্দ যে বক্তৃতা রেখেছিলেন তাতে একটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে। বর্তমানে ভারতীয় ব্যবস্থায় যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উত্থান ঘটেছে এটা তিনি ১৩০ বছর আগেই অনুভব করতে পেরেছিলেন এবং বিশ্বকে বক্তৃতার মাধ্যমে সতর্ক করেছিলেন। প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ধর্ম আছে। এটি সত্য কিন্তু তার নিজের ধর্মের ওই যে সংকীর্ণতাকে তিনি কুয়োর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, প্রত্যেকটি ধর্মীয় মানুষ নিজস্ব ধর্মীয় কুয়োর সংকীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ থেকে নিজের ধর্মকে বিশ্বে পরিব্যপ্ত বলে মনে করছে। এটা হিন্দু মুসলিম খৃষ্টান প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সর্বজনকে যা ধারণ করে সেটাই ধর্ম– এই চিন্তার পরিসর থেকে তথাকথিত ধর্মবাদীরা বিচ্যুত। তাই ধর্ম তার ধর্মের ব্যাপকতা বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়নি। এর মধ্যে দিয়ে শুধু ভারতবর্ষের বর্তমান চরিত্র নয় বিশ্বজুড়ে যে ধর্মীয় কুসংস্কারের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে তা তিনি ১৩০ বছর আগেই উপলব্ধি করেছিলেন। তারই বাণী– জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। তিনিই বলেছেন, জীব সেবাই শিবসেবা। যুবদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, হে বীর সাহস অবলম্বন কর! তিনি জীবনের বাস্তবতা কি বোঝাতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, গীতা পাঠের চেয়ে ফুটবল খেলা ভালো। তিনি বলেছেন, পেটে খিদে নিয়ে পড়াশোনা হয় না।

তিনি সন্ন্যাসী তিনি একজন ধর্মীয় মানুষ এই তথাকথিত প্রচলিত ধারণা উপেক্ষা করে বলা যায় যে তিনি ভারতবর্ষের প্রগতির কথা ভেবেছিলেন, যুবকদের নিয়ে অনুধাবন করেছিলেন

শিকাগো মহাসম্মেলনে প্রারম্ভিক বাক্যবন্ধন যে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিল তাতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, হে আমেরিকাবাসী আমার ভগিনী ও ভ্রাতাগণ! এই উচ্চারণের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেবার প্রয়োজন আছে। এই বাক্যটির মধ্যে যে আন্তরিকতা যে সৌভ্রাতৃত্ব রয়েছে তা ঐতিহাসিক হয়ে গিয়েছে। এভাবে জনসম্বোধন ও জনতাকে স্বাগত বিশ্বে আর কেউ কোনদিনও জানাননি। আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য তিনি অনুভব করেছিলেন নারীজাতির উত্থান ব্যতীত দেশমাতার জাগরণ সম্ভব নয়। তার এই উচ্চারণে তিনি নারীদের প্রথম স্থান দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, হে আমেরিকার ভগিনী ও ভ্রাতাগণ! ভ্রাতাদের চেয়ে ভগিনীদের তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।