বিপ্লবী গণেশ ঘোষের জন্মদিনঃতিনি কাঁচরাপাড়ায় এসেছিলেন

অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদন

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের নায়ক মাস্টারদার ইন্ডিয়ান রিপাবলিক আর্মির ফিল্ড মার্শাল কাঁচরাপাড়ায়ঃ আজ ২২শে জুন তাঁর জন্মদিন

তমাল সাহা

আমরা কি? না, বাঙালি। বঙ্গোপসাগরীয় উপকূলের মানুষ। বিপ্লবী সম্পর্কে আমাদের চেতনা উপলব্ধি হঠাৎ করে এই ২০২০ – র ২২ শে জুন অত্যন্ত তীব্র মাত্রায় বেড়ে গেল নাকি! দেখছি একটি লেখা খুব ভাইরাল হয়েছে এই ডিজিটাল যুগে। হোয়াটসঅ্যাপে হোয়াটসঅ্যাপে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে এই লেখাটি। এই মানুষটির শতবর্ষ পার হয়ে গিয়েছে ২২ জুন ২০০০ সালে। তখনও তাঁর সম্পর্কে এত আলোচনা দেখিনি। শতবর্ষ অতিক্রান্ত হবার প্রায় কুড়ি বছর বাদে হঠাৎ আমাদের মনে পড়লো তাঁকে। আমরা বাঙালি জাত, না বজ্জাত– এই প্রশ্নটি উঠে এলো আমার মাথায়।

ঠাকুর দেবতা সম্পর্কিত একটা চিন্তা ভাবনা, কেমন ছিল তা সেটি ধরা পড়ে তাঁর আচরণে। এবং রাইফেল সম্পর্কিত তাঁর যে অগাধ জ্ঞান সেটিও ধরা পড়েছে সেই লেখায়। এটি অত্যন্ত সুখবর।

বিপ্লব! বিপ্লব! করে বাংলা সেই কবে থেকে হা- পিত্যেশ করে আছে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন, সূর্য সেন এইসব সিনেমা যখন বাংলার কোনো প্রজন্ম দেখে তখন কি সে এখনকার রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সেইসব স্বদেশী বিদ্রোহের নায়কদের একবার মিলিয়ে নেয়?

এমন এক বিপ্লবীর মুখ কাঁচরাপাড়া দেখেছিল কোনোদিন। তাঁর কথা মনে পড়ে গেল আবার মোবাইল মিডিয়ায় এই লেখাটি পাঠের পর।

তাঁর পরিধেয় সাদা ধুতি, সাদা শার্ট আর অমন সাদামাটা সাদাসিধে চেহারার মানুষ কি করে বিদ্রোহের নায়ক হয়! মাস্টারদার ইন্ডিয়ান রিপাব্লিক আর্মির ফিল্ড মার্শাল ছিল সে। এই বিপ্লবীর পদধূলিতে ধন্য হয়েছিল কাঁচরাপাড়া।

১৮ এপ্রিল, ১৯৩০। পুরো অস্ত্রাগার দখল হয়ে গিয়েছিল তাঁর নেতৃত্বে। আহা! কত রাইফেল! কত গোলা বারুদ না তোমরা বুকে আগলে ধরেছিলে প্রিয় দেশের জন্য। দুদিনের জন্য হলেও স্বাধীন বিপ্লবী অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল চট্টগ্রামে।

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে একবার এসেছিল সেই বিপ্লবী আরও দুই বিপ্লবীকে সঙ্গে নিয়ে কাঁচরাপাড়ায়।সেটা ছিল ১৯৪৬।সাল। বাঁশের কেল্লার মহান কারিগর তিতুমিরের দেশে যাবে তাঁরা। বারাসাতের নারকেলবেড়িয়া গ্রামে। সেখানে তিতুমিরের শহিদ বেদীতে মালা দেবে। কাঁচরাপাড়া থেকে বাসে করে হরিণঘাটা। হরিণঘাটা থেকে বাসে যাবে তাঁরা বারাসাত।

কাঁচরাপাড়া স্টেশনে তাঁদের নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন অম্বিকা চক্রবর্তী, অনন্ত সিং আর এই গণেশ ঘোষ। সম্বর্ধনা দিয়েছিল কাঁচরাপাড়ার কমিউনিস্টরা। মানে অমূল্য উকিল, কুঞ্জ বোস,ননী সেনরা।এটা ছিল নাগরিক সংবর্ধনা। কংগ্রেস নেতারা,শহরের সুধীজন মুক্তি চট্টোপাধ্যায়, তুলসী দত্তরা উপস্থিত ছিলেন সেই সভায়। বক্তব্য রেখেছিলেন সংবর্ধিত তিন বিপ্লবী।

আর সেই বিপ্লবী গণেশ ঘোষ দক্ষিণ কলকাতার নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সির কাছে পরাস্ত হয়েছিলেন। তখন এই বৈপ্লবিক সত্তাকে সাধারণ মানুষ কেমন গুরুত্ব দিয়েছিল তা প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও সেটা ছিল কংগ্রেসী সন্ত্রাস পর্বের কাল–১৯৭১ সাল।

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন তো এক বুক দাপানো চলচ্চিত্র। তিনি যুগান্তর দলের সদস্য ছিলেন। বোমা বানাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। জেলই হয়তো ছিল তাঁর জীবন। ১৪ বছর তো সেলুলার জেলেই তিনি বন্দী জীবন কাটিয়েছিলেন। তাছাড়া ভারত রক্ষা আইনেও গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন।পরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৫২- ৫৭- ৬২, তিনবার বেলগাছিয়া বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে হয়েছিলেন দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের সদস্য।

কমিউনিস্টরা পুজো মানে না। তিনি কেন পুজো উদ্বোধনে গিয়েছিলেন সেই কৈফিয়ত দিয়েছেন।

খোলামেলা ঘোষণা করেছিলেন, সামাজিক সৌজন্যবোধে সর্বজনীনতার কারণে তিনি উদ্বোধনে অংশ নিয়েছিলেন। এই সন্ত্রাস পর্বে চাঁদাবাজদের সম্মুখীনও হয়েছিলেন তিনি৷ তাদের ফালতু অস্ত্রের ঝনঝনানিতে তিনি আতঙ্কিত হননি। বরং সেই নিষ্কর্মা অস্ত্রটি তিনি তাদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন। এবং অস্ত্র সম্পর্কিত একটি জ্ঞানও দিয়েছিলেন।

২০১০ সালে আশুতোষ গোয়ারিকারের নির্দেশনায় একটি সিনেমা নির্মাণ করা হয়– “হামসি জানে সে”। এই চলচ্চিত্রটি গণেশ ঘোষের জীবনকেই কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছিল।

সেই বিপ্লবী গণেশ ঘোষের শতবর্ষ পূর্ণ হয়ে গিয়েছে ২২ জুন, ২০০০। আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁকে যা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তখন কি এই গুরুত্ব পেয়েছিল সে?

সেই সংবর্ধনার কথা কি তোর মনে আছে কাঁচরাপাড়া? তোর মনে আছে বিপ্লবী গণেশ ঘোষের লেখা চট্টল ব্রিগেডের সেই কবিতা!

Slowly slowly mile by mile/March forward to the grave/to the dale of death,/to the world of fame/March forward,/Oh youths the brave….