বিনয় ভরদ্বাজ, অবতক খবর, ১৮ই জুন ::  ২৩ শে মে ২০১৯, এই দিনের পর সারা বাংলায় রাজনৈতিক চিত্র হঠাৎ করে পাল্টে গিয়েছিল। ৪২ টি সিটের থেকে ১৮টি তে জয় করে বিজেপি এতটাই উৎসাহিত ও আত্মহারা হয়ে ওঠে যে যেন তারা সম্পূর্ণ বাংলায় জয় করে ফেলেছে। একে একে তৃণমূল নেতাকর্মীরা দল ত্যাগ করে রাতারাতি বিজেপি হয়ে ওঠেন। অন্য তৃণমূল নেতারা এলাকায় ঘর বাড়ি ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নেন। কারণ তাদের উপরে ভয়ানক ভাবে সন্ত্রাস তৈরি করে বিজেপি ক্যাডাররা।

এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নেন ঘরে লুকিয়ে থাকা চরম বামপন্থী ক্যাডার গুন্ডারা। তৃণমূলের চাপে যে বামপন্থী নেতা ক্যাডাররা ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন তারা আট বছর ঘরে কাটিয়েছেন। তারা এই সুযোগকে কাজে লাগান আর তাদের রাগ মেটাতে গেরুয়া ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। বিজেপি নেতারা এটা অতিরিক্ত পাওনা হিসেবে নেন ও কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছাড়াই বামপন্থীদের তাদের দলে নেন আর এখানে বিজেপি নেতারা মার খেয়ে যান। কারণ দলে এসেই এই নবাগতরা তাদের স্বার্থসিদ্ধি করতে রাস্তায় নেমে পড়ে গেরুয়া পতাকা ও জয় শ্রীরাম ধ্বনি দিয়ে।

দলের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন স্থানীয় বিজেপি নেতা ও মন্ডল সভাপতিরা। তারা হঠাৎ করে বিশাল জনস্রোতের ক্ষমতার নেশায় অন্ধ হয়ে পড়েন। শুরু হয়ে যায় গেরুয়া তান্ডব। তান্ডবে প্রবীণ বিজেপি কর্মী নেতারা তেমন ভাবে অংশগ্রহণ করেননি তবুও সমস্ত এই তাণ্ডবের দোষ এসে পড়ে ওই দলের শীর্ষ নেতাদের উপরেই। নির্বাচনের পর মাত্র দুই মাসের জন্য বিজেপি দল প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়লেও এর মধ্যে বাম থেকে রামপন্থী হওয়া গুন্ডা নেতারা তাদের সমস্ত জোর-জুলুম ভয় দেখিয়ে মানুষকে অতিষ্ঠ করে তোলেন।

কিন্তু এটা বাস্তব যে তান্ডব, জোর জুলুম বা ভয় দেখিয়ে মানুষকে বেশিদিন ঘরে আটকে রাখা যায়না। হলোটাও তাই। ভয় ও তাণ্ডবের দিন কাটতেই যারা ভয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন তারা ফের তাদের পুরনো ঘরে ফিরে আসতে শুরু করে দেন, ফের অবস্থা পাল্টায়। প্রায় 70-80 শতাংশ ক্যাডার বাহিনী উদ্ধার করে নেয় তৃণমূল কিন্তু কুড়ি থেকে ত্রিশ শতাংশ মানুষ বিজেপির পক্ষেই থেকে যান বিভিন্ন কারণবশত।

এই যে বিজেপিতে থেকে গেলেন যারা তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ বামপন্থীদের রয়ে গেছে। যারা বাম থেকে রাম হয়ে তৃণমূলকে হটাতে গেরুয়া পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলেন। কারণ তাদের লক্ষ্য তৃণমূলকে হারানো আর তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে দীর্ঘদিন ধরে বসে থেকে বামফ্রন্টের হাত ধরে তৃণমূলের সঙ্গে লড়াই করা যাবে না। তাই তারা এখন রামপন্থী হয়ে উঠেছেন।

দ্বিতীয়তঃ সেসকল মানুষগুলো যাদের উপর 2011 থেকে 2019 পর্যন্ত তৃণমূল নেতা ক্যাডাররা গুন্ডারা চোখ রাঙিয়ে ছিলেন, তাদের শোষণ করেছিলেন তারা এখন রামের পতাকায় অর্থাৎ গেরুয়া পতাকা, গেরুয়া শিবিরে নাম লিখিয়েছেন। তাছাড়া ধর্মীয় কারণে এক শ্রেণীর হিন্দু ভোটার বিজেপির পক্ষে আগে থেকে রয়েছেন আর কিছু হিন্দুদের মাথায় এটাও ঢুকাতে সক্ষম হয়েছে যে বিজেপিকে ক্ষমতায় না আনলে ক্ষমতা মুসলিমদের হাতে চলে যেতে পারে। এছাড়াও রাজ্যের তৃণমূল নেত্রী হিন্দিভাষীদের নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য বহু হিন্দিভাষীদের বিজেপির দিকে ঠেলে দিয়েছে।

লোকসভা নির্বাচনের এক বছর পর তৃণমূলকে রাজ্য থেকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করতে বিজেপি এখন সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কেন্দ্রীয় নেতা অমিত শাহ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাকে নিয়ে যে তৎপরতা ও সক্রিয়তা দেখাচ্ছেন তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাদের নতুন টার্গেট পশ্চিমবঙ্গ।

তবে নির্বাচনের পর বিজেপির ক্ষমতা যে হঠাৎ করে কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল তা ধীরে ধীরে এক বছরের মাথায় অনেকটাই কমেছে। তাছাড়া তৃণমূল প্রশান্ত কিশোরকে দিয়ে দলের ভাবমূর্তি বাড়াতে যে সকল কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন তাতেও অনেকটাই কভার করতে পেরেছে তৃণমূল।

তবে এখানেও ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি নিয়ে কিছু প্রশ্ন, কিছু ত্রুটি ব্যাপকভাবে সামনে চলে এসেছে। দিদিকে বলো– কর্মসূচি গ্রহণ করে তৃণমূল বেশ ভালো ফল করে অনেকটাই রিকভার করতে পেরেছে ,তারা মানুষের মন জয় করতে সকলে নেমে পড়েছিলেন। নিচুতলার তৃণমূল নেতাদের মনে এই ভয় ঢুকে গেছিল যে দিদিকে বলো ফোনের মাধ্যমে তাদের সমস্ত দুর্নীতির তথ্য সরাসরি দিদির কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। তারা ভয়ে ভয়ে দুর্নীতি ছেড়ে মানুষের মুখোমুখি হতে শুরু করে দিয়েছিলেন কিন্তু এই কর্মসূচির সাফল্যের ওপরে শেষের পদক্ষেপ জল ঢেলে দেয়।

দিদিকে বলো– কর্মসূচি শেষে যেসব তথ্য যে প্রশান্ত কিশোরের হাতে বা যেসব এলাকার নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ রাগ দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছিল, তার দলকে শক্তিশালী করার জন্য ব্যবহার করার কথা ছিল। যেখানে যেখানে দলের  অবস্থা খারাপ, যে যে নেতারা দুর্নীতিতে মেতেছিলেন , যাদের বিরুদ্ধে মানুষে ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের রাগ দিয়েছিল, সে সব

তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যবহার না করে সমস্ত তথ্য এলাকার সেই নেতা-নেত্রীদের কাছেই দিয়ে দেওয়া হয় যাদের বিরুদ্ধে মানুষের রাগ ধৃনা ছিল। তারা ভাবলেন যে ওই নেতা-নেত্রীদের তথ্যগুলো পাঠিয়ে দিলে তারা হয়তো তাদের এলাকাগুলো রিপেয়ার করে ফেলবেন। প্রশান্ত কিশোরের টিম ও তার এটাই পরিকল্পনা ছিল কিন্তু হল উল্টোটা। এখানেই মার খেয়ে গেল প্রশান্ত কিশোরের নীতি ও ভাবনা।

সমস্ত তথ্য হাতে পেয়ে এলাকার এলাকার রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা তাদের ভুলত্রুটি শুধরে না নিয়ে জন সম্পর্ক তৈরি তে মন না দিয়ে  উল্টো দিকে হাঁটলেন। যারা যারা অভিযোগ করেছিল তাদের বিরুদ্ধে তারা ঘুরে ঘুরে অভিযান শুরু করলেন।  মারধর ও তাদের চাপ দিয়ে অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য বাধ্য করতে শুরু করলেন।  আর এখানেই হারিয়ে ফেলল এই কর্মসূচির সমস্ত সাফল্য।

দিদিকে বলো– কর্মসূচিতে ফোন করে বিপাকে পড়ে গেলেন বহু মানুষ। সোজা কথায় বলতে গেলে এত টাকা খরচ করে, এত সময় খরচ করে, মনোযোগ দিয়ে যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল তাতে শেষমেষ জল ঢেলে দিলেন স্থানীয় লোকাল তৃণমূল নেতা নেত্রীরা ।

এছাড়া করোনা নিয়ে রাজ্য তৃণমূল সরকার যেভাবে কাজ করেছে, তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি বিজেপি কর্মী নেতারা। তৃণমূল নেতারা যখন এলাকায় এলাকায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তাদের বাড়ি বাড়ি ত্রাণ পৌঁছে দিতে ব্যস্ত তখন দু-একজন বিজেপি নেতা ছাড়া বেশিরভাগ নেতারাই ঘরে বসে দিন কাটিয়েছেন। বিজেপি যখন দেখলো যে তাদের পা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে মানুষের মধ্যে ছিঃছিঃ হচ্ছে তখন শেষের দিকে তারাও প্রাণ দিতে মাঠে নামতে শুরু করলে তৃণমূলের নেতারা তাদের বাধা দিতে শুরু করে দেন, আর এখানে গন্ডগোল করার সুযোগ পেয়ে যায় বিজেপি। সোজা কথায়  বিনি পয়সায় রাজনীতি করার সুযোগ তৈরি করে দেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা তাদের বাধা দিয়ে। তৃণমূল নেতাদের অদূরদর্শিতার সুযোগ করে দেয় বিজেপি নেতাদের । আর এটাকে ভাঙ্গিয়ে তারা রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে মাঠে নেমে পড়ে।

শুধু তাই নয় বাংলায় বিজেপির হয়ে হাতে ব্যাট নিয়ে মাঠে নেমেছেন রাজ্যপাল স্বয়ং। তাঁর কর্মকাণ্ড থেকে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। যিনি সব সময় তার ক্ষমতা ও পদের সুযোগ নিয়েই এই সাম্মানিক পদে বসেও রাজনীতি করে চলেছেন।  সরকারকে তার সাংবিধানিক নীতিরীতি মেনেই তাকে উত্তর দেওয়ার দক্ষতা দেখানো দরকার।

এছাড়া সামনের নির্বাচনকে পাখির চোখ করে বিজেপি এরাজ্যে নবীন-প্রবীণদের নিয়ে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে তাদের প্রচারে নেমে পড়েছে। তারা প্রধানমন্ত্রীর চিঠিকে মানুষের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার অছিলায় জনসংযোগ শুরু করেছেন কিন্তু এখনো তৃণমূল তাদের জেলায় জেলায় গোষ্ঠীদ্বন্দ মেটাতে সক্ষম হয়নি বা উদ্যোগও নেয়নি।

তাছাড়া লোকসভা নির্বাচনের পর ফ্রন্টলাইনে নেতা-নেত্রীরা যখন ভয়ে ঘরে ঢুকে গেছিলেন তখন মুখ্যমন্ত্রীর আহবানে প্রাক্তন তৃণমূলী প্রবীণ নেতারা যারা ঘরে বসে ছিলেন তারা সামনে এসে দলকে উদ্ধারের কাজে নেমে পড়েছিলেন। তারা দলকে পুনরায় ক্ষমতায় আনার জন্য, তাদের শক্তিশালী করার জন্য তাদের সর্বস্ব মান-অভিমান ত্যাগ করে মাঠে নেমেছিলেন কিন্তু দল ফের সংগঠিত হয়ে আবার শক্তিশালী হতেই ঘরে লুকিয়ে যাওয়া নেতারাই আবার নিজের হাতে ক্ষমতা তুলে নেন আর এই দলের সম্পদ প্রাক্তনীদের তারা আবার ঘরে ঢুকিয়ে দিতে  ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যারা এগিয়ে এসে লড়াই করে আবার দলকে সংগঠিত করেন , তাদেরকে মুখ্যমন্ত্রীও ভুলে গেলেন। তাদের কোন পদ বা দায়িত্ব দেওয়া হলো না। নতুন কমিটিও গঠন করা হলো না। সেই পুরনো অভিযুক্ত নেতা কর্মীরাই আবার দখল করে নিয়েছে ক্ষমতা। তারাই ফের নেতৃত্বে যাদের উপরে রাগ অভিমান করে বাংলার মানুষ বিজেপির পক্ষে রায় দিয়েছিলেন।  এই দিকে আর নজর পড়ছে না দলীয় নেত্রীর। তাই দল থেকে ফের নিজেকে সরিয়ে নিতে শুরু করে দিয়েছেন প্রবীণরা। এইসব কারণগুলো মিলিয়ে তৃণমূল যে আগামী নির্বাচনে ফের বিপদে পড়তে চলেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।