প্রস্তুতিপর্ব / তমাল সাহা

সমুদ্র সফেন উপকূলীয় এই জলবায়ুতে
সমস্ত মরশুম জুড়েই
গণতন্ত্র নেবেন, গণতন্ত্র নেবেন– রব ওঠে।
বিকীর্ণ তেজে এই বীরভূমব‍্যাপী গরিবি প্রদাহ চলে–
কোটি-কোটিপতিরা গরিবদের কথা ভাববে বলে মন্ত্রী হয়ে যায় এবং ভাবতে ভাবতে
নিজেরা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মেতে উঠে পাঁচশো-হাজার গুণ সম্পত্তি
বাড়িয়ে নেয়–
বাজারি গণতন্ত্রের এই মুজরা দেখে আমরা হাততালি দিয়ে নিজেদের নন্দিত করি।

নুন মাখানো এই গণতন্ত্রে জনগণের মন্ত্রীরা এক রুপিয়া বেতন নিলেও এই দেশের ভানুমতীর ভোজবাজি
তাদের বানিয়ে দেয় উপচে পড়া সম্পদের সত‍্যবান-সত‍্যবতী
আর কৌন হ্যায় মাইকা লাল বলে রাজনীতির জোচ্চোরেরা হলফনামায় মিথ্যে তথ্য ঠেসে দিয়ে
হাড়-বজ্জাত নির্বাচন কমিশনকে উপঢৌকন পাঠিয়ে দেয়—
তারা প্রত্যেকেই প্রথম পাণ্ডব বলে তাদের প্রদত্ত তথ্যের বিচার সত‍্যি বলে স্বীকৃতি পেয়ে যায়।
ফলে তাদের এমপি-এম এল এ-র পদ কোনোদিনও বাতিল হয় না।
ভোটের বাতাসে এই গণতন্ত্র ‘বেড়ে গণতন্ত্র’ বলে জয়ধ্বনি ওঠে।
এই মুক্ত গণতন্ত্রে
ঘুষখোর-দাগিরাও মন্ত্রিসভা উজ্জ্বল করে
মানবসম্পদ উন্নয়ন, সংস্কৃতি দপ্তরের দায়িত্ব বৃষস্কন্ধে বহন করে
ফলে গণসচেতনতা বৃদ্ধির কাজটি দ্রুত গতিতে চলতে থাকে!

এই গণতন্ত্র তো অবাধ,
ফলে বাইক বাহিনী ছড়িয়ে পড়ে
শিক্ষা-স্বাস্হ‍্য চবুতরায়
মাস্কেট বাহিনী বারুদ নিয়ে খেলা করে অবলীলায়
সশব্দ চলাচলে তারা ছোট ছোট ঘটনার বৃক্ষ রোপন করে উদ‍্যানপালন বিদ‍্যায় তুখোড় হয়ে ওঠে।

আচ্ছে দিন মার্কা সততার ছাপ্পামারা এই গণতন্ত্রের শপিং মলে হরেক কিসিমের জিনিস পাওয়া যায়,এমন কি
জল জমি জঙ্গল বিক্রির মালপত্তর–
সেইসব পণ‍্যসম্ভারের দিকে আমরা বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি অনেকক্ষণ…

কিছুক্ষণ বুড়ো আঙুল চুষি–
তারপর?

তারপর বিধিলিপির উপর সমস্ত দায় চাপিয়ে দিয়ে
অনেক বাধা-বিপত্তি, হুমকি-শাসানির পরেও
ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখি—
দুটাকা কেজি চালখাওয়া আমার বাবাকে
বিধবা ভাতা পাওয়া আমার দিদিমাকে
বার্ধক্য ভাতা পাওয়া আমার দাদুকে
শুধু আমার দাদা নয়,
যুবশ্রী শোভিত পাড়ার দাদাদেরও।
এইসব দেখে আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি আর শেষ পর্যন্ত উন্মাদনায় কন‍্যাশ্রী খেতাব বুকে আগলে রেখে যে আমি সদ‍্য শারীরশিক্ষায় সচেতন হয়েছি সেই আমিও গণতান্ত্রিক স‍্যানিটারি ন‍্যাপকিন ও জুতো পরে সাইকেল চেপে ভোট দেবার বয়স হবার আগেই ‘ভোটরাজের জয় হোক’ স্লোগান তুলে দাঁড়িয়ে পড়ি এবং
দেখতে থাকি
জলার পাশে পড়ে থাকা
ধ্বস্ত কিশোরীর দেহ
চা-বাগানে পড়ে থাকা অনাহারী লাশ
কৃষিজীবীর আত্মঘাতী মৃতদেহ
বন্ধ কারখানার গেটে
অবস্থানরত কামারের বিষণ্ণ মুখ।

দিল্লির লালকেল্লা থেকে ছুটে
আসা স্বচ্ছ অভিযানের ভারতীয় বাতাস আমাকে জানিয়ে দেয়– বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক মালগুদাম নির্মাণ হতে চলেছে ভারত মহাসাগরের তীরে,
কিন্তু রাত্রি ঘনতম হয়ে এলে দূর থেকে ভেসে আসা এক আশ্চর্য ধাতব শব্দ
আমি শুনতে পাই…
উত্তর হিমালয় থেকে দক্ষিণ মহাসাগর, পূর্বঘাট থেকে পশ্চিম ঘাট পর্যন্ত
নক্ষত্র সাজানো সীমাহীন আকাশের নিচে গোপন অন্ধকারে সংখ‍্যায় কম হলেও
কারা যেন রাইফেলের নল সাফ-সুতরো করে যায়…

আপনারা কি সেই সৃজনশীল শব্দ শুনতে পাচ্ছেন?
আমি জঙ্গলমহলের মেয়ে—
সিধো-কানুর বংশধর
বিরসা মুন্ডার প্রজন্ম
রক্তে আমার অরণ্যের তারুণ্য
রক্তে আমার লড়াইয়ের তুফান
আমি
জনজাতি আদিবাসী ভারতী মুর্মু
আমি শুনতে পাচ্ছি….