প্রথম স্বাধীনতা দিবস ১৯৪৭,কাঁচরাপাড়ায় দাঙ্গা ও গান্ধিজির ঐতিহাসিক আগমন/তমাল সাহা

প্রথম স্বাধীনতা দিবস ১৯৪৭,কাঁচরাপাড়ায় দাঙ্গা ও গান্ধিজির ঐতিহাসিক আগমন
তমাল সাহা

ইতিহাসবেত্তা মানুষের কাছে কাঁচরাপাড়া একটি বিস্ময়। কাঁচরাপাড়া যে কী পারে বা পারে না, তা কাঁচরাপাড়া নিজেও জানে না। কাঁচরাপাড়ার জীবনে ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটেছিল ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের দিন- পনেরই আগস্ট, ১৯৪৭ শুক্রবার। ভ্রাতৃত্ব যেখানে জাগতিক উদ্দেশ্য, সেই মহান লক্ষ্যকে পদদলিত করে কাঁচরাপাড়ার বুকে ঘটেছিল ব্যাপক দাঙ্গা— সে এক রক্তক্ষয়ী হত্যাকান্ড। রক্ত মেখে কাঁচরাপাড়ার বুকে দাঁড়িয়ে রইল স্বাধীনতা।

রাজনৈতিক তথা সাম্প্রদায়িক বিভাজনে সারা রাজ্যে সেই কলঙ্কিত ঘটনার চিরকালীন সাক্ষী হয়ে রইল কাঁচরাপাড়া

ওয়ার্কশপ রোড, মুর্গীপাড়া, শ্রীলক্ষ্মী সিনেমা অঞ্চল ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের ডেরা। ওয়ার্কশপ রোডে এখনকার অমর স্টোর্স আর ইউনিয়ন বিড়ির কারখানাটি ছিল বিশাল বিশাল মুসলিম হোটেল। ওয়ার্কশপ রোডের ওপর ছিল সুপরিচিত মিউনিসিপ্যাল কমিশনার জামিয়াত মিঞার চকমিলান বাড়ী।

একটি ধর্মের দৌরাত্ম্য চললে অন্য ধর্মও বিধ্বংসী হয়ে ওঠে। হিন্দুস্থান ন্যাশনাল গার্ড গড়ে উঠেছিল এইখানে। কার্যালয় ছিল ঘটক রোডে গোপাল রায়ের সানরাইজ স্টুডিওর উল্টোদিকে তারাপদ রায়চৌধুরীর দোতলা কোঠাবাড়ির নীচের তলায়। সভাপতি ছিলেন ডাঃ ক্ষিতীশ মুখার্জী। তখন হিন্দু মহাসভার সভাপতি ছিলেন বিজয়বসন্ত নন্দী। ৯০০ ভলান্টিয়ার ছিল এই ন্যাশানাল গার্ডে। এই বাহিনীকে ট্রেনিং দেবার জন্য শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী কলকাতা থেকে একজন ট্রেনারও পাঠিয়েছিলেন। বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন প্রাণেশ মিত্র।

সন্ত্রস্ত কাঁচরাপাড়ার এক সম্প্রদায়ের মানুষের মনে সাহস যোগানোর জন্য ন্যাশনাল গার্ড তখন ঘটক রোড থেকে বনগাঁ রোড হয়ে থানা মোড় ছুঁয়ে শ্রীলক্ষ্মী সিনেমা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কুচকাওয়াজ করে বেড়াতো।

সেদিন ১৫ আগস্ট সকাল বেলাটা ছিল আনন্দোজ্জ্বল। গোষ্ঠ নন্দীর লরি চেপে ‘জয় হিন্দ’ আর ‘ বন্দেমাতরম’ স্লোগানে মুখর কিশোরেরা শহর পরিক্রমা করছিল। থানা মোড়ে ছিল স্বাধীনতা দিবসের শোভাযাত্রার জটলা। সকাল থেকেই প্যারেড শুরু করেছিল হিন্দুস্থান ন্যাশনাল গার্ডের সদস্যরা। ঘটক রোড হয়ে ওয়ার্কশপ রোড পর্যন্ত একটি দীর্ঘ মিছিল বেরিয়েছিল তার এক মাথা ছিল থানা মোড়ে আর মিছিলের লেজ ছিল নাকি লিচুবাগান পর্যন্ত — এ সব জানিয়েছিলেন বলহরি নন্দী ও শক্তিপ্রসাদ দে। তাঁরা দু’ জানাই এখন প্রয়াত।

স্বাধীনতা দিবস ঘোষণার কয়েকদিন আগে থেকেই উত্তজনা ছিল চরমে৷ রটে গিয়েছিল নৈহাটি পর্যন্ত পাকিস্তানের দখলে চলে যাবে। আনন্দে উৎসাহিত হয়ে ১৪ আগস্ট মিছিল বের করেছিল মুসলিম লীগ। ৮-১০ টা লরি। তাতে পাকিস্তানের পতাকা। লরীতে ছিলেন মুসলীম লীগের প্রেসিডেন্ট এক্স-এন বি আর খান আর অন্যান্যরা হলেন আলাউদ্দিন, জান মহম্মদ, হোসেন আলি, তাহেরউদ্দীব, নিজাম, রুস্তম, হেদায়েত আলি, ইত্যাদিরা। সামনে পুলিশের গাড়িতে বিজপুর ওসি নাসিরুদ্দিন।

অবশ্য এরও আগে থেকেই সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন হচ্ছিল কাঁচরাপাড়ায়। মন্ডল বাজারের কাছে নন্দ শেঠের শিব মন্দির ছিল– বটগাছ তলায়। তা পরবর্তীকালে অনেকেই দেখেছেন। বেদখল জমির ওপর এই মন্দিরটি থাকায় তা পরে ভেঙে ফেলা হয় পৌরসভার তত্ত্বাবধানে। সেই শিব মন্দিরে বিষ্ঠা ত্যাগ করেছিলেন বিধর্মী জনৈক আলি (নাম জানা থাকলেও উল্লেখ করছি না)।এতে উত্তেজনা ছিল চরমে। পরে সেই বিধর্মী আলিকে এর চরম খেসারত দিতে হয়েছিল জঘন্য ভাবে — বলহরি নন্দী আর বনমালী সিংহরায়ের খপ্পরে যারা পড়েছেন তারাই শুধু জানেন প্রতিশোধের মর্ম।

স্বাধীনতা দিবসের প্রথম দুপুর। দুপুর ছাড়িয়ে সূর্য হেলেছে সামান্য একটু। অবস্থার অবনতি হতে থাকলো। কবরখানা ময়দান ছাড়িয়ে একটু দূরে মুসলিম লীগ নেতা সেই আলাউদ্দিনের বাড়ি। জড়ো হচ্ছিল দাঙ্গাবাজরা। তার বাড়ির ছাদে উড়ানো হলো পাকিস্তানের পতাকা। কিছু দুর্বৃত্তের হাতে পিস্তল।

সন্ধের দিকে ঘটে গেল বিস্ফোরণ। গোলা-গুলি শুরু হয়ে গেল। রেলের ডাঃ বৈদ্যনাথ মুস্তাফী। তিনি ছিলেন শিক্ষক,এক সময়ের সিপিএম সদস্য ও কাউন্সিলর বাবু মুস্তাফীর পিতা। তিনি ফিরছিলেন নিজের অস্টিন গাড়ি করে। তিনি গুলিবিদ্ধ হলেন। ঘটনা ঘটে গেল কবরখানা অঞ্চলে।

খবর হয়ে গেল চতুর্দিকে। উন্মত্ত হয়ে উঠলো কাঁচরাপাড়া। অন্য সম্প্রদায়ও প্রস্তুত– বেরিয়ে পড়লো তরোয়াল, বর্শা, বল্লম, লাঠি। হার্ণেট স্কুলের ছাত্র মৃত্যুঞ্জয় ভট্টাচার্য বন্ধু অশোক ব্রহ্মচারীর বাড়ি থেকে আড্ডা দিয়ে ফিরছিলেন। তার ডান- বাঁ পায়ে সবসুদ্ধ চারটে ছররা ও তিনটি গুলি বিঁধে গেল। মৃত্যুঞ্জয় ভট্টাচার্যের মৃত্যুর ভুল সংবাদে পরদিন স্কুলও ছুটি হয়ে গিয়েছিল।

ওয়ার্কশপ রোড। এখন যেখানে হরিসভা, তার উল্টোদিকে যোগেন দে’র দোকান। সেখানে আড্ডা দিচ্ছিলেন দীর্ঘদেহী ডাকাবুকো মানুষটি। তার সাঙ্গপাঙ্গ মাখন ভট্টাচার্য, পচা শেঠ(সবজান্তা), বিন্দে, বনমালী সিংহদের নিয়ে সেই ‘মহিষাসুর’ বলহরি নন্দীর কথা বলছি। তারা সে সময় হিন্দুস্তান ন্যাশনাল গার্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এদিকে থানা মোড়ের দিক থেকে রব উঠলো– গুলি করে পালাচ্ছে! দেখা গেল একজন মোটরবাইক চালক দুজন আরোহীকে নিয়ে ছুটে আসছে। বাইকের সামনে তারকা চিহ্নিত পতাকা।

ঘটে গেল সেই দুঃসাহসিক ঘটনা। আসুরিক শক্তি নিয়ে যোগেন দে-র দোকান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ‘মহিষাসুর’ সেই চলমান বাইকের ওপর। তারপর! সেতো রক্তপাত আর স্তব্ধতার ইতিহাস। আর নীজাম ও রুস্তমকে এখনকার হকার্স কর্ণারের ভেতরে আমগাছে বেঁধে চাবকেছিলেন কে, তাতো অনেক প্রত্যক্ষদর্শীরই মনে আছে।

১৫, ১৬, ১৭ আগস্ট তিন দিন ধরে চললো দাঙ্গা। কবরখানার চারদিক তখন বেশ উঁচু করে পাঁচিল ঘেরা। উন্মত্ত জনতার প্রহারে মৃত যুবকের লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছিল পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে কবরখানার ভিতরে। মানিকতলা গোরস্থান অঞ্চলে তখন ভয়ঙ্কর অবস্থা। মুর্গিপাড়া, সতীশ নন্দী রোড উত্তেজনায় টানটান। কাঁচরাপাড়া রেল স্টেশনে পড়ে থাকলো ভুঁড়ি ফাঁসা দুটো লাশ। প্রিয়নাথ রোডের বড় ড্রেনের কার্লভাটের নীচে পড়ে রইলো একটি দেহ। স্পল্ডিং রোডের পাওয়ার হাউসের কাছে হুমড়ি খেয়ে আছড়ে পড়লো আরেকটি দেহ।

কার্ফু জারি হয়ে গেল। প্রশাসনিক দায়িত্ব নিয়েছিলেন এসডিও মেজর ব্যানার্জী। রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল জাঠ রেজিমেন্ট। তখনো কানে ভেসে আসছে একদিকে ‘বন্দেমাতরম’ অন্যদিকে ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি। দাঙ্গায় কলুষিত হলো কাঁচরাপাড়া।

ভয়ঙ্কর দাঙ্গার খবর শুনতে পেলেন মহাত্মা গান্ধী। শান্তি ফেরাতে তিনি ছুটে এলেন ১৯ আগস্ট। মহাত্মা গান্ধীকে ড্রাইভ করে নিয়ে এলেন হুড খোলা গাড়িতে সোরাহবর্দি সাহেব। সঙ্গে ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষ। ইতিহাস হয়ে গেল মানিকতলার কবরস্থান ময়দান। গান্ধীজী এসে থামলেন মানিকতলার হারিয়ে যাওয়া সেই অশ্বত্থ গাছের নীচে। সেখান থেকে চলে গেলেন স্পল্ডিং ময়দানের শান্তিসভায় যোগ দিতে। শান্তি স্থাপনের প্রক্রিয়ায় অবশ্যই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন রিভলবার মাস্টার বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী।
স্পল্ডিং মাঠে অনুষ্ঠিত সেই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন গোষ্ঠবিহারী দে। সেই ঐতিহাসিক দৃশ্যপট বন্দি করে রাখলেন পাঁচ টাকায় কেনা এনসাইন ইন্ডিয়া ক্যামেরাতে যার গায়ে লেখা ছিল FUL VUE FLEX SYNCHRO FLASH। গোষ্ঠ দা বলেছিলেন,এটা আমার হাতে তোলা প্রথম ছবি। হাত কেঁপে গিয়েছিল রে, ভাই!

হায় রে দাঙ্গাবাজ কাঁচরাপাড়া! প্রথম স্বাধীনতা দিবসের দিনই তোর গায়ে লেগে গেল সাম্প্রদায়িকতার কলঙ্কের দাগ আর পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িক দলের হাতেই নিহত গান্ধীজী নিজের চোখে দেখে গিয়েছিলেন সেই রক্তাক্ত চিহ্ন।

স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে কাঁচরাপাড়ার পুরানো স্মৃতি ও কিছু ছবিঃ

কাঁচরাপাড়ায় দাঙ্গা প্রথম স্বাধীনতা দিবসেঃ ১৯ আগস্ট গান্ধীজি ও সোরাহবর্দি‌ শান্তি কমিটির ডাকে আয়োজিত সভায় স্পল্ডিং ময়দানে।

ছবিঃ গোষ্ঠবিহারী দে।

প্রথম স্বাধীনতা দিবসে থানামোড়ে মিছিল : ছবি গোপাল রায়; সান‌রাইজ স্টুডিও ঘটক রোড।

থানা মোড়ে স্বদেশি আন্দোলনের ছবি

ছবি: গোষ্ঠ বিহারী দে