দু-পয়সা বেশি রোজগারের জন‍্য চাষি হয়ে যায় ঢাকী, শিশু শ্রমিক হয়ে ছেলে বাজায় কাঁসি

পার্বণী / তমাল সাহা

ভাগচাষী ব্রজেশ্বর,
আকাশ ও মাটি খুব ভালো করে চেনে।
ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি এলেই টের পায়
আকাশের রং পাল্টাতে শুরু করেছে।

আকাশ, বিশাল আকাশ।
নীলের শুদ্ধতায় কেমন যেন
স্নিগ্ধ সুখে আচ্ছন্ন হতে থাকে।
ব্রজেশ্বর বোঝে হাল্কা সোনা রোদ
আকাশকে আদর করছে,
মাঝে মাঝে যে উড়ান বৃষ্টি
তা তো সোহাগের ঝিরিঝিরি জল।

তবে ব্রজেশ্বর অনেক চেষ্টা করেও
বুঝতে পারেনা তখন কেন খেতের
আল বরাবর এত কাশফুল ফোটে?
সে তো কোনদিন কাশবীজ ছড়ায়নি জমিতে!
কিন্তু সে জানে
কারও বুকে কেন ফুল ফোটে
গর্ভাধান হয়, পরাগরেণু কিসের কথা বলে।
ভালোবাসার বিষয় আশয়
মাটি ও ফুল আমাদের থেকে
অনেক আগেই জানে।

ঘরে ফিরে তার মন আনচান করে ওঠে।
উঠোনে পা দিতেই
কেউ আসবে বলে তার মনে হয়,
নাহলে এত শিউলির সুবাস কেন উঠোন জুড়ে!
শিউলি খুব আনত ফুল,
নিজেকে সমর্পণ করা তার স্বভাব।

এইসময়টা ব্রজেশ্বরের হাতের আঙুলগুলো
ঢেউ তুলতে চায়।
ঘরের ভেতর মাচা, বাঁশের বাখারির উপর
মাটি চাপান দেওয়া
সেখান থেকে জয়ঢাকটা সে নামায়।
ময়ূরপঙ্খী ঢাক তার।
ঝুল জমেছে ঢাকের গায়ে,
পঙ্খীর সাদা পালকে।
সে সাফসুতরো করে
পালকগুলো সাবান জলে ধুয়ে
রোদের আশ্রয়ে রাখে।
ঢাকের ছটগুলোকে টানটান করে বাঁধে।
লাঙলের সুখে কড়া পড়েছে শক্ত হাতে,
সেই হাতে ঢাকের চামড়ার বেড়িতে
সজোরে ঘা দেয়।
তারপর আঙ্গুলের দাপটে
টনটন শব্দ তোলে ঢাক।
এসব তার পাশে বসে
খুব নজর করে দেখে মহেশ্বর—
ব্রজেশ্বরের একমাত্র ছেলে,
বয়স আট বছর।

এবার ছেলেকে সঙ্গে নিলে মন্দ হয় না,
ভাবে ব্রজেশ্বর।
পার্বণীটা একটু বাড়বে।
সে উঠে নেচে নেচে ঢাক বাজিয়ে রেওয়াজ করে।
ছেলের হাতে কাঁসিটা ধরিয়ে দেয়—
বাবু, বাজা দিখিনি তালে তালে।
মহেশ্বর ওত পেতেই ছিলো,
সে বাজাতে শুরু করে।
ছেলের তালজ্ঞান দেখে
ব্রজেশ্বরের খুব সুখ হয়।
প্রথম হাতেখড়ি,
ভুলচুক হলে বাপ শুধরে দেয়।

নোয়াবিলে ফুটেছে লাল শালুক।
শেষরাতে হাওয়াটা হিমে যেন
একটু নুইয়ে পড়েছে,
শিশিরের জল মুখে মেখেছে মেঠো ঘাস।
ডাকের সাজ,সলমা, জরি,বুলানের কারুকাজে
প্রতিমা সেজে ওঠার আগেই
পৌঁছে যেতে হবে কুন্ডু বাড়ির সিংহদরজায়।
কত্তা-গিন্নিমাকে প্রণাম সারতে হবে
কুশল জিজ্ঞাসাবাদ, কত কথা হবে!
সেই একবছর পর দেখা—
হায়!জমা টাকা শেষ হয়ে যায়,
জমা কথার কি শেষ আছে!

দুই বাজনদার মাঠের আলপথ ধরে চলেছে
পেছনে হেলানো রোদ,সামনে তাদের ছায়া।
চার চারটে দিন ঢাক-কাঁসির তালে চলবে মহামায়ার পুজো—
সন্ধ্যেয় আরতি আর বাবুদের
ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা।

অপলক চোখে,
জ্যোতির্ময়ী প্রতিমা নিশ্চয়ই তাদেরও দেখবে, ভাবে ব্রজেশ্বর।
মহেশ্বরের গায়ে হাতওয়ালা গেঞ্জি
তার ওপর ছোট ধুতি পরিয়ে
কোমরটাতে শক্ত করে বেড় দিয়ে
বেঁধে দিয়েছে ব্রজেশ্বর।

বাপের কাঁধে জয়ঢাক,
ছেলের হাতে কাঁসি।
চলতে চলতে বেজে চলে
ঢাক ও কাঁসির যুগলবন্দি‌
বাপ বাজায় তরুর তরুর তাক
ছেলের কাঁসিতে বোল ওঠে কাঁই না না
ভাসতে ভাসতে সুর চলে যায় বহুদূরে…

পথেও কথা থাকে
মহেশ্বর বলে, তুমি এবার আমারে
সঙ্গে নিচ্ছো কেনে,
সে তো আমি জানি বাপ।
অ-এ অজগর আসছে তেড়ে,
প-এ পুজো,
প-এ পেট
প-এ পয়সা বেশি আসবে ঘরে।
বাপ তো হতবাক!
তারপরেই হাই তুলে ছেলে বলে,
কুন্ডু বাড়ি আর কতদূর বাবা?
আমার খুব খিদে পেয়েছে।

মা তো অন্নপূর্ণা,
তাকে সর্বজয়া বলে ডাকো–
ইয়া দেবি, সর্বরূপেণ সংস্থিতা
অন্নম দেহি,বস্ত্রম দেহি
মা গো! মা!মা গো!