১৪ নভেম্বর। ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর জন্মদিন। তার জন্মদিনকে শিশুদিবস বলা হয়। তিনি কাঁচরাপাড়া এসেছিলেন কবে? কখন? কীভাবে?

ভারতের রাজনীতিটাই যেন তাদের পরিবারকে কেন্দ্র করে নিয়ন্ত্রিত। তিনি কল্যাণীতে কংগ্রেসের উনষাটতম অধিবেশনে যোগ দিতে কাঁচরাপাড়া এসে পৌঁছেছিলেন ১৯ জানুয়ারি বিকেল ৪ টে বেজে পাঁচ মিনিটে। সেটা ছিল উনিশশো চুয়ান্ন সাল। অধিবেশন বসেছিল ২০ জানুয়ারি। চলেছিল ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন অতুল্য ঘোষ।

যুগান্তরের রিপোর্ট থেকে জানতে পারছি প্রায় বিশ হাজার মানুষ তাঁকে দেখবার জন্য কাঁচরাপাড়া এরোড্রোমে হাজির ছিলেন।

শীতের পড়ন্ত বেলা। বেড়া ডিঙিয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তছনছ করে অসংখ্য আদুর গায়ে মানুষ তার দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। নেহেরুজীকে নিয়ে ল্যান্ড রোভার জীপটি রেল কলোনি ওয়ার্কশপ রোড, বাগমোড় হয়ে কল্যাণী পৌঁছেছিল। কল্যাণীর অধিবেশন স্থলের নামকরণ করা হয়েছিল কংগ্রেস নগর। কংগ্রেস নগরে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌঁছনোর পথ পূর্ব নির্দিষ্ট ছিল। তা সত্বেও তাকে অন্য পথ দিয়ে ঘুরিয়ে আনা হয়েছিল। এর কারণ অবশ্য জানা যায় নি।

কল্যাণীর এই অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, জগজীবন রাম, সঞ্জীব রেড্ডির মতো নেতারা। উল্লেখ্য এই অধিবেশনে ২৩ শে জানুয়ারি সকাল নটায় নারী সম্মেলনে সভানেতৃত্ব করেছিলেন রাষ্ট্র সংঘের সাধারণ পরিষদের সভানেত্রী বিজয়লক্ষ্মী পন্ডিত।

চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কসে নির্মিত শততম রেল ইঞ্জিনটি জনসাধারণকে প্রদর্শনের জন্য এই অধিবেশনে আনা হয়েছিল। ইঞ্জিনটি রাখা হয়েছিল কল্যাণী ঘোষপাড়া সাইডিং এ
আর ভারতীয় রেলওয়ের শতবার্ষিকী উপলক্ষে একটি বিশেষ প্রদর্শনী ট্রেনও আনা হয়েছিল।

এই অধিবেশনেই ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনে কমিশন গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন জগজীবন রাম। বাংলার পক্ষ থেকে প্রতাপ চন্দ্র গুহ রায় বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে জোরালো ভাবে এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলেন। বাঙালি জাতি ও ভাষার উজ্জীবনে সে এক ইতিহাস হয়ে থাকবে।

প্রতাপ চন্দ্র গুহরায় যখন বাংলায় তার বক্তব্য পেশ করছিলেন তখন সভায় ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সেই পরিস্থিতি ২৫ জানুয়ারি প্রকাশিত যুগান্তরের প্রতিবেদন থেকে তুলে ধরছিঃ

“মাননীয় সভাপতি, প্রতিনিধিবৃন্দ আর মা বোনেরা…”
প্রতাপ চন্দ্রের এইটুকু বক্তৃতা শুনেই অবাঙালি প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে ধ্বনি উঠলো– “বাংলা ভাষা নহী সমঝতা হ্যায়”। লাফ দিয়ে নিজের আসন ছেড়ে উঠে এলেন ক্ষুব্ধ নেহরুজী। প্রতাপ বাবুর বক্তৃতার মঞ্চে মাইক্রোফোনের কাছে ছুটে গিয়ে তিরস্কারের সুরে হিন্দিতে বললেন, যারা বাংলা বুঝতে পারছেন না বলে অভিযোগ করছেন তারা সভা ছেড়ে চলে যেতে পারেন। কই, হিন্দি ভাষায় বক্তৃতা দেবার সময় বাঙালিরা তো বুঝতে পারছিনা বলে চেঁচায় নি। ভারতীয় সংবিধানে তো ভারতের সমস্ত ভাষারই সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। এ কি জানেন না আপনারা? আর এতদিন যে প্রদেশে বার্ষিক কংগ্রেস হয়েছে তার বক্তৃতায় সে প্রদেশের ভাষাও ব্যবহৃত হয়েছে। এও কি জানেন না? আপনারা বাংলা যদি না বুঝতে পারেন তবে তা বাড়ি গিয়ে শিখে আসুন।

এসব প্রায় ৭০ বছর আগেকার কথা। তখন কাঁচরাপাড়া জুড়ে ভিটেমাটি ছাড়া মানুষের ভীড়। কল্যাণী তো রুক্ষ মরুভূমি। উল্লেখ্য এই কংগ্রেস অধিবেশন মঞ্চেই AICC র সদস্য হিসাবে কাঁচরাপাড়ার রমেশ গোস্বামী রোডের বাসিন্দা আমাদের গর্ব PCC সদস্য, টাউন কংগ্রেস সভাপতি নরেন দে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একই মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন। এখন মনে পড়ে যায় সেসব ঘটনার খন্ডহর চিত্র।