ধারালো কলমের সাংবাদিক যখন ময়দানে

সক্রিয় ময়দানে সাংবাদিক। সে মনে করছিল রাজনীতি ছাড়া জীবন হয় না এবং সাংবাদিকতা মানেই দেশের মুখ। আর দেশের মুখ মানেই শোষিত মানুষের মুখ। ‌সেই দিকেই থাকবে সাংবাদিকের ধারালো কলমের অভিমুখ।সেই সাংবাদিক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় আজ তাঁর জন্মদিন।

ধারালো কলমের সাংবাদিক যখন ময়দানে

তমাল সাহা

ক্রমাগত রাত্রির অন্ধকার ঘনতর হতে থাকে। আরো গভীরতর হলে নক্ষত্ররা দিশেহারা হয়ে কোথায় যেন ডুবে যায়! তখন গাঙ্গেয় তটভূমে হাঁটতে থাকলে কিছু সাহসী সুসংবাদ স্মৃতিবাহী হয়ে ওঠে। সাংবাদিকতায় দায় ও দায়বদ্ধতা বৃশ্চিক নক্ষত্রের মতো কত প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়! সেই মুহূর্তে তোমার মুখটি মনে পড়লে বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়া শব্দটিকে খুব দুর্বল বলে মনে হয়। পেইড নিউজ, ইয়োলো জার্নালিজম,দালাল সংবাদপত্র শব্দ সম্ভারসমূহ কানে ঘণ্টাধ্বনির মতো বেজে চলে আর বারবার দেখি তোমার মুখ।

কে শুনেছিল জানিনা, তোমার মৃত্যুর পর এমন কথাই তো বাতাসে ঘুরেছিল, তুমি নাকি জীবনের শেষ বেলায় আচ্ছন্ন ঘোরে বলেছিলে, গিরীশ! তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে তো গিভ দ্য প্রুফ। গিভ দ্য মেশিন প্রুফ।

সংবাদপত্র! সংবাদপত্র! এই শব্দটি তোমার মাথা খেয়েছিল।সংবাদপত্র ও দেশের মুখ একাকার করে দিয়েছিল তুমি তোমার শানিত কলমে।

কেউ কি কোনোদিন শুনেছে বৃহস্পতিবার সকাল শুরু হতেই বড়লাট ক্যানিং সাহেব দূত পাঠিয়ে দিয়েছে সাংবাদিক-সম্পাদকের দপ্তরে,সেখান থেকে কিনে আনবে তোমার সংবাদপত্রটি, নাম যার হিন্দু প্যাট্রিয়ট।

১৮৫৩ সালে পত্রিকাটি মুখ দেখেছিল‌। তখন তা ছিল সাপ্তাহিক। পরে এপ্রিল ১৮৯২ সাল থেকে পত্রিকাটি দৈনিক হয়ে যায়। ‌

কেউ কি কোনোদিন শুনেছে সম্পাদক সাংবাদিকের বাসস্থান হয়ে উঠেছে নিপীড়িত অত্যাচারিত নীল চাষীদের অতিথিশালা ও আশ্রয়গৃহ। সাংবাদিক মশাই নিজেই উদ্যোগী হয়ে খরচপত্র করছেন তাদের দেখভালের জন্য, গঙ্গাপদ্মার দুপার থেকে ছুটে আসা অসহায় চাষীজনকে দিচ্ছেন আইনি পরামর্শ, বারবার আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াচ্ছেন, শুনানিতে সওয়াল জবাবে হাজির হচ্ছেন অত্যাচারিত চাষীদের পক্ষে।

এই না হলে সংবাদপত্রের সম্পাদক! প্রতিদানে তুমি শুনেছো অকথ্য অশ্রাব্য গালিগালাজ।

গ্রাম বাংলার ‘প্রলেতারিয়েত’দের প পাশে এক সম্পাদক কলমে ও সশরীরে সমান সক্রিয়।

তুমি অনুসন্ধানে জানলে ক্যারেল, ব্লুম, লারমুর, ,রেনি,কিং,ডেভিস নীলকর সাহেবরা এপার ওপার বাংলা জুড়ে নীলকুঠি বানিয়ে রায়তদের উপর চালাচ্ছে নির্মম অত্যাচার। চাষির বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া,লাঠিয়াল দিয়ে চাষীদের পেটাই।চাষি বউ মেয়েদের বিবস্ত্র করে নির্যাতন তারপর বলাৎকার। তুমি দেখলে একে একে বর্শাবিদ্ধ। রায়তের রক্তঝরা পিঠ।

নীল চাষীদের উপর নারকীয় জুলুম প্রকাশ্যে নিয়ে এলে দুঃসাহসিকতার সঙ্গে। সাংবাদিক হিসেবে দ্রোহ নির্মাণ করলে কলম- ভাষ্যে।পত্রিকায় তুমি খুলে ফেললে নতুন বিভাগ-ইন্ডিগো ডিস্ট্রিক্ট। সেটা এপ্রিল মাস ১৮৬০।

আর সিধু কানু! সেই সারা জাগানো সাঁওতাল বিদ্রোহ– হুল।তাতে সোজাসুজি স্পষ্ট সমর্থন জানিয়েছিলে তুমি। ২৫ হাজার সাঁওতাল হত্যার বর্বরতার বিরুদ্ধে, ব্রিটিশরাজের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তুমি ছিলে গর্জনশীল কামানের এক শাব্দিক বিস্ফোরণ। অন্যান্য সংবাদপত্র যখন এই নিচু স্তরের প্রান্তিক জনজাতির বিদ্রোহের প্রতি উদাসীন তখন তুমি, তুমিই ছিলে সোচ্চার।

সংবাদপত্র বা সাংবাদিক রাজনৈতিক হতে পারে? তুমি বললে, হতে পারে মানে! হবেই তো। ‌ লর্ড ডালহৌসির রাজ্যশাসন নীতি এবং স্বত্ববিলোপ নীতিকে সরাসরি বিরুদ্ধচারণ করেছিলে তুলে এবং এই বিরুদ্ধতা এতই চাবুকের মতো ছিল যে, তৎকালীন বুদ্ধিজীবী সমাজ ভীত শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল যে তোমার বিরুদ্ধে প্রতিআক্রমণ না নেমে আসে। ‌তবে জানা যায়,ডালহৌসি তোর মুখ বন্ধের জন্য বড় প্রলোভনও দেখিয়েছিলেন। রাষ্ট্র এই ভাবেই কিনে নিতে চায় সাংবাদিক ও সংবাদপত্রকে। তুমি ঘোষণা করেছিলে, রাজনৈতিক হয়ে ওঠো।বলো, ভারতবর্ষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার একমাত্রৎভারতবাসীর, সাম্রাজ্যবাদীদের নয়। আর জানিয়ে দাও, জীবন ও রাজনীতি একাকার। জীবন বাদ দিয়ে রাজনীতি হয় না। রাজনীতি বাদ দিয়ে জীবন হয় না।

হায়! জীবনের প্রথম প্রভাতে ডালহৌসি স্কোয়ারে কোনো নিলামদার কোম্পানির দপ্তরে দশটাকা বেতনে বিল লিখতে তুমি। তারপর মিলিটারি অডিটর জেনারেলের অফিসে কপিরাইটার মানে নকল নবিশ,নকল নবিশ থেকে কেরানি, কেরানি থেকে সহকারী অডিটর। এসব কি তোমার পোষায়?

আর সেই ইস্কুলের বেলাতেই সাহেব পেটানোর ঘটনা এখন মনে পড়ে। ভারতবাসীকে যে সাহেব বলেছিল,’ব্লাডি ইন্ডিয়ান নিগার’ তাকে কী পেটানটাই না পিটিয়েছিলে তুমি!

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর! তাঁর পাশে যখন কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না তখন তুমি একক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠো। বিধবা বিবাহ প্রচলন ও নারী শিক্ষা প্রসারে তুমি তাকে মদত যোগাও। তার পক্ষে কলম ধরেছিলে। তুমি দেখিয়েছিলে কয়েকটা সংবাদ ধারালো ভাষায় বর্ণনা করলেই সাংবাদিক হওয়া যায় না। তার দায় ও দায়িত্ব রয়েছে। তাকে সক্রিয় ময়দানেও নামতে হয়।

এখন মনে পড়ে সেই ১০ হাজার টাকা মানহানির মামলার কথা। কি করে তা সামাল দিয়েছিলে তুমি? বিশাল তো ঝুঁকি নিয়েছিলে, সোজাসুজি প্রকাশ করেছিলে সেই খবর‌– অর্চিবল কর্তৃক। হরমণি নামের মহিলাকে হরণ। আর তার প্রতিশোধ নিতে তোমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছিল সাহেব।

তুমি বলেছিলে, সাংবাদিকতা মানে সময়ের ইতিহাস। সাংবাদিক দেখবেনা সময়ের মুখ, লিখবে না সে কথা? লিখবে না তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা?

জীবনের প্রান্তিকে তোমার মুখ দেখে গিয়েছিলেন দীনবন্ধু মিত্র, তখন হাতে তার নীল দর্পণ। তোমার সাক্ষাতে এসেছিলেন জেমস্ লং। আর কালীপ্রসন্ন সিংহ। সে এক ইতিহাস।

ভবানীপুর হরিশ মুখার্জী রোডে তোমার মাথাগোঁজার ঠাঁই,যেটা হেরিটেজ বিল্ডিং ঘোষিত হয়েছিল। পরে তা ভেঙে চুরমার করে দেওয়াহয়। জানিনা হরিশ মুখার্জী রোডে এখনো সেই ফলকটি আছে কিনা যাতে তোমার নাম খোদাই করা ছিল।

কোনোদিন কোনো সাংবাদিকের উদ্দেশ্যে কবিতা লেখা হয় নাকি? তোমার উদ্দেশ্যে জনৈক লোককবি লিখেছিল কয়েকটি লাইন, যা এখন হয়ে গেছে ঐতিহাসিক— ‌

নীল বানরে সোনার বাংলা করলো ছারখার।

অসময়ে হরিশ মল্লো লঙয়ের হলো কারাগার।

চাষীর এবার প্রাণ বাঁচানো ভার।

গঙ্গার তীরবর্তী ভবানীপুরে হাঁটতে হাঁটতে এখনও দেখি রাষ্ট্রীয় উল্লাস।

লালমুখো ইউরোপিয়ানরা যখন ১০০ টাকার উপর বেতন পায় আর তাদের ঘোষিত এই ব্ল্যাক নিগাররা যখন সেই বেতন থেকে বঞ্চিত তুমি সোচ্চারে বলেছিলে, এদেশের সম্পদ লুট করে ফাঁকি দিয়ে অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে তোমরা কোটি কোটি মুদ্রা নিয়ে চলে যাও এই দেশ থেকে, আর আমাদের বঞ্চিত করবে সেটা চলতে পারেনা।

প্রতিবন্ধী সাংবাদিকতার এই কৃষ্ণপক্ষ কালে তোমার মুখ খুব মনে পড়ে আর আমি তাকিয়ে থাকি তোমার ওই শানিত কলমটির দিকে।