ডায়মন্ড সার্কাসঃঅবতকের সাক্ষাৎকার ও প্রতিবেদন

পাড়ায় সার্কাসঃ
ডায়মন্ড সার্কাসের অন্দরমহল
তমাল সাহা

সবাই গান গায়। পৃথিবী জুড়ে গান। শোভন বাইক চালাতে চালাতে বলে, দাদা! সব জায়গায় গান আছে? আমি বলি, হ্যাঁ। আকাশে মেঘ বৃষ্টি নক্ষত্র জ্যোৎস্নার গান, পর্বতে মহামৌনতার গান, অরণ্যে পাতার গান, নদীতে জলধারার গান, সমুদ্রে গর্জনশীল ঢেউয়ের গান, ক্ষেতে ফসলের গান। ততক্ষণে পৌঁছে গেছি কল্যাণী রথতলার মাঠে। ডায়মন্ড সার্কাস তাঁবু ফেলেছে সেখানে। শোভন বলে, এবার তাহলে শুরু হলো আমাদের সার্কাসের গান।

সার্কাস! সার্কাস; সার্কাস আসলে লাইফ সার্কেল– জীবন বৃত্ত। রিং-র মতই জীবন। গ্রীক শব্দ কিপকক ল্যাটিন শব্দ ক্রিপস হয়ে ইংরেজিতে সার্কাস-এ রূপান্তরিত হয়েছে। খুনসুঁটির যেমন ইংরেজি হয় না তেমন সার্কাস শব্দটিরও বাংলা হয় না। ম্যানেজার কর্ণদেব রায় বলেন, সার্কাসের জীবন জিপসির জীবন-যাযাবর জীবন। এখানেই জীবনের মজা। দুনিয়া ঘোরো আর খেলা দেখাও এবং দেখো।

বেলা বারোটা তখন। মাথার উপরে গনগনে সূর্যের রৌদ্রের গান চলছে ।একটায় ম্যাটিনি শো। কর্ণদেব বলেন, খেলা দেখে যাবেন। আমন্ত্রণ রইল। খেলার দু-একটা শট নিয়ে নেবেন। করোনাকালের বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। সার্কাস একটা বিশাল শিল্পকর্ম– ওয়ার্কশপ। যৌথ শ্রম ও সৃজনের কাজ চলে এখানে। সারা ভারতে ৪০০টার মতো সার্কাস ছিল এখন মেরেকেটে চল্লিশটা। ইন্টারন্যাশনাল, এম্পায়ার কোহিনুর, নটরাজ, অলিম্পিক, মুনলাইট, রাইনো, ওয়েস্টার্ন এসব দল উঠে গেছে। ডায়মন্ড, রোলেক্স টারজান, অজন্তা, এশিয়াড, গোল্ডেন, রেম্বো, জেমিনি, গ্রেট জাম্বো এখন এইসব দল আছে। তিনি বলেন,সার্কাস বিনোদন শিল্প হলেও জীবন ঝুঁকির শিল্প। এখানে জীবন প্রতি মুহূর্তে হাতের তেলোয় নাচে। এখন বাঘ সিংহ হাতি নেই তখন সার্কাসে প্রাণী বৈচিত্রের আকর্ষণ ছিল কিন্তু প্রতিমুহূর্তে জীবন ছিল বিপদাপন্ন ও আতঙ্কের। সরকার বলে, পরিবেশবিদ বলে জন্তু বাঁচাও কিন্তু আমাদের জান যে বাঁচে না!

আমি আকাশ ছোঁয়া হাই বা টপ টেন্টের দিকে তাকিয়ে থাকি। দেখি আফ্রিকার যুব খেলোয়াড়েরা প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা কেনিয়া থাকে। এরা পাঁচজন শিল্পী ছ’মাসের ভিসা নিয়ে এসেছে। প্রয়োজনে ভিসার সময় সীমা বাড়াতে হবে, জানালেন ম্যানেজার বাবু। টপ টেন্ট ঘিরে চারদিকে ২৫ টা লিভিং টেন্ট। এখানে সার্কাস শিল্পীরা থাকে। সর্বজনীন রান্নার টেন্টও আছে। কোন কোন শিল্পী নিজের ইচ্ছেমত রান্না করে খায়। আমি বলি পার্ক সার্কাসের রাশিয়ান সার্কাসে আসতো, সিঁথির মোড়, বারুইপুর, সোদপুরে সার্কাস আসতো। তিনি বলেন, সেই বাজার আর কোথায়? দু’বছর করোনার করুণায় আমরা প্রায় মরে গেছি। আমি বলি, সার্কাসের গুরুত্ব আছে। মেরা নাম জোকার তো সার্কাস নির্ভর সিনেমা। রাশিয়ান সার্কাসের দৃশ্য আছে সেখানে আর জোকার রাজু, তাকে কি ভোলা যায়! শিকারি সিনেমায় গ্রেট রেমন সার্কাসের দৃশ্য আছে। বিগ বস রিয়েলিটি শো-র স্টেজ সার্কাসের থিমে বানানো হয়েছে।

কেনিয়ার জিমন্যাস্টদের সঙ্গে কথা হলো। তারা যা বলে তা বাংলা করলে দাঁড়ায়, ইন্ডিয়ায় আমরা ভালো আছি। তারা বলতে চায় দেখাতে দেখাতে আনন্দে আমরা মুখে আওয়াজ করি। শুনেছেন তো আপনাদের শিস ধ্বনি ও খুশির প্রকাশ! আপনাদের হাততালিতেই আমাদের বুক ভরে যায়।

আমার তো চিরকালই সার্কাসের নারীদের পছন্দ। বিশেষ করে খেলার আইটেম নিবেদনের পর তাদের বিশেষ শারীরিক বিভঙ্গ ও মুদ্রা আমাকে ছুঁয়ে যায়। যে মোটা ফর্সা মেয়েটি রিং ও দড়ির খেলা দেখায় সে বলে, ফর্সা কালো যাই হই আমাদের মেকআপ করতেই হবে, আমাদের নিজেদের সুন্দর করে তুলতে হয় দর্শকদের কাছে। নিজেকে আকর্ষণীয় না করে তুললে দর্শক আমার খেলা দেখবে কেন? আমাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য, ক্রীড়া প্রদর্শনের শৈলী যেমন একটা শিল্প তার সঙ্গে জুড়ে দিতে হয় বিনোদন। সামগ্রিকে সেটাই সার্কাস শিল্প।একটা আইটেমের পর আরেকটা আইটেম উপস্থাপনের সময় আমাদের বিনোদনের উপর জোর দিতে হয়। সুন্দর কথা বলে সার্কাস রমণীরা। আর ওই মেয়েটি শুরুতে বড় একটা রিংয়ে বসে প্রায় সামিয়ানার মাথা ছুঁয়ে জিমন্যাস্টিক দেখায় সে মুখে অল্প হাসি নিয়ে বলে, এসব খেলা আমাদের কাছে জলভাত। তার জুটি তরুণীটিও পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। সে বলে, তবে সার্কাসে ফুরসত নেই। নিয়মিত প্র্যাকটিস ও রিয়ার্সাল দিতে হয়।

সার্কাসের মেয়েদের বাইরের পুরুষের সঙ্গে সাধারণত বিয়ে হয় না। ওতো সার্কাসের মেয়ে! ওকে বিয়ে করবে কে? সার্কাসের মেয়েদের সার্কাসের পুরুষদের সঙ্গেই সাধারণত বিয়ে হয়।

এই গরমে সার্কাস চলে? সার্কাস তো শীতের দিন বড়দিনে আসে! ম্যানেজার সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। সার্কাসের এখন আর কোনো ঋতু নেই। বর্ষা বাদে সব ঋতুতেই সার্কাস চালাতে হয়। জীবন সার্কাস যে থামতে চায় না রিপোর্টার বাবু! এই সিস্টেমটা একবার ভেঙে গেলে শিল্পীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে‌। জোড়া দিতে প্রচুর সময় অর্থ শ্রম ব্যয় করতে হয়। তাই বছর জুড়েই সার্কাসের ব্যবসা চালু রাখতে হয়। এর সঙ্গে শুধু আমার পেট নয়। সার্কাস শিল্পীদের পেটও যে জড়িত। থেমে থেমে কথা বলেন ম্যানেজার বাবু।

আগের দিন এসেছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম মেয়েরা অন্তঃসত্ত্বা হলে কি করেন? ম্যানেজার বলেন, ছুটি দিতে হয়। তবে খেলা চলে কিভাবে? অন্যজনকে রিপ্লেস করতে হয় অথবা অন্য খেলার আইটেম ঢুকিয়ে দিতে হয়।
সার্কাসের কুশলীরা কেউ স্বচ্ছল নয়। অর্থ স্বাচ্ছল্য থাকলে কেউ কি আর সার্কাস দেখাতে আসে, না সার্কাস দেখতে আসে? এতো দার্শনিক কথা।

এসে পড়ল দুই জোকার গৌরাঙ্গ ঘোষ ও বেনু দাস একজনের উচ্চতা আড়াই ফুট অন্য জনের উচ্চতা প্রায় চার ফুট। দেহের বামনত্বই তাদের পণ্য। তাদের বাঁকা পায়ে হাঁটা, মুখের আওয়াজ, অভিনয়,হাতের ওই ব্যাটের অদ্ভুত শব্দ– এসবই তাদের জীবনের সওদা। তারা বলে, এই পেশা ছাড়া আর আমাদের কোন পেশা আছে? ভগবান তো এজন্যই
আমাদের বানিয়েছিল।
বেনু দাস বলেন, ১৮ বছর ধরে এই কাজ করছি। গৌরাঙ্গ ঘোষ বলেন, এইতো মাইনে সামান্য! ছয় জনের সংসার চালাতে হয়। আমাদের মতো জোক আর কে করতে পারে? আমরা হলাম শুধু সার্কাসের নয়, এই দুনিয়ার জোকার।

রাজুর জোকার জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছিল সিনেমা মেরা নাম জোকার ১৯৭০ সালে। রাজুর জীবনে তিনটি নারী এসেছিল– বস্তির মিনুর সঙ্গে তার প্রেম হয়েছিল, স্কুল শিক্ষিকা ম্যারিকে সে সে পরিধেয় পোশাক বদলানোর সময় তার নগ্নতা দেখেছিল, বড় হয়ে সে যখন জোকার হয়েছিল সেই সার্কাসের রাশিয়ান সুন্দরীর সঙ্গে তার বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতা নিবিড় চুম্বনের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। মেয়েটির নাম ছিল ব্যালারিনা কেসেনিয়া। তার জীবন সার্কাস দেখাতে সে এই তিন ভালোবাসার নারীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
বিষাদ আনন্দ প্রেম ও পেটের পুঁজি নিয়েই সার্কাস।

আর আমি! মহাভবঘুরে আরেক জোকার। সার্কাস কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা শেষে টপ টেন্টের রিং-এর ভেতরে ঢুকে পড়ি। কেন্দ্রীয় দীর্ঘ মোটা মাস্তুলটির দিকে এগিয়ে যাই। তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে মাথা নিচু করে তারপর হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়ে আসি। মাথার উপর দিয়ে গরম বাতাস জানিনা কোন গান গাইতে গাইতে চলে যায়….