অন্যদুর্গা ——এক

বাংলা বৈচিত্রময়ী। বাঙালির চরিত্র বোঝা দায়! বাঙালিরাই পারে। তারা দুর্গাকে কতদূর নিয়ে যায়! প্রতিমা সামনে রেখে দ্যাখো, শাসককে কেমন চ্যালেঞ্জ জানায়

চ্যালেঞ্জিং দুর্গা
তমাল সাহা

কে সেই চ্যালেঞ্জে জিতলো? ব্রিটিশ না বিপ্লবীরা ? এই চ্যালেঞ্জের উত্তর তো জানা। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিপ্লবীরা যে জিতবে সে তো বলে দিতে পারে তারাও, যারা মূক, বধির ও কানা।

সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে। বিপ্লবীরাও তারই সঙ্গে জেগে ওঠে। মেদিনীপুর চ্যালেঞ্জের দেশ। ক্ষুদিরাম চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা।

স্বাধীন তাম্রলিপ্তের কথা মনে পড়ে? মনে পড়ে কে সেই সুশীল ধাড়া ?
মেদিনীপুরের মাটি সাচ্চা মেদিনী। ১৯৩১,৩২,৩৩। বিপ্লবীদের হাতে খুন হলো পর্যায়ক্রমে তিন অত্যাচারী জেলাশাসক পেডি, ডগলাস এবং বার্জ। কারা হত্যা করেছিল? আবার সেই সুভাষচন্দ্র।

সুভাষচন্দ্রের দলের বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স। আগ্নেয় সন্ত্রাস তৈরি করেছিল অনুশীলন সমিতি এবং বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স যৌথভাবে ব্রিটিশ রাজত্বের বিরুদ্ধে।

ফলে কেউ কি আর আসতে চায় জেলার মাতব্বরিতে! শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট পদে এলেন পি জে গ্রিফিথ।

সান্ধ্য আইন। যাকে বলে কার্ফু জারি হলো। কংগ্রেস দল সহ সমস্ত ধরনের সংগঠন, স্কাউট,ব্যায়াম, আখড়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ হলো। পাঠানো হলো ১৮০০ পাঠান সেনা। মেদিনীপুর তখন পুরোপুরি জেলখানা।

তাহলে কি পুজো হবেনা? প-এ পুজো, প-এ পুলিশ। তো কি? প- এ পিস্তল। হবে প্রাণ দেওয়া নেওয়া। কে জেতে দেখি! আইন আইনের পথে চলবে। কিন্তু পুজো হবে। এগিয়ে এলেন ব্যারিস্টার বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, ক্ষীরোদ বিহারী দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ খান, অক্ষয় দাশগুপ্ত।

পুজোর উদ্যোগ নেওয়া হল। পুজো নিষিদ্ধ। মায়ের পুজো নিষিদ্ধ করবে কে?

১৯৩৪ সাল। পুজোর জমিতে নো অবজেকশন চাই। জানিয়ে দিল প্রশাসন। নো অবকেকশন না থাকলে পুজো করা যাবে না। আর যে নো অবজেকশন দেবে, দিলেই সে চলে যাবে গরাদের ভেতরে।

আরে ইংরেজ! তুমি কী সোনার চাঁদ! ঘুঘু দেখেছো, দেখোনি ফাঁদ। ব্রাহ্ম সমাজ দিল নো অবজেকশন। যারা পুতুল পুজো বিরোধী তারাই দিল পারমিশন।

এই আমার বাংলা! বিপ্লবীদের প্রাণকেন্দ্র কর্ণেল গোলায় পুজোর আয়োজন হলো। দুর্গা হলো পুরোপুরি স্বদেশি। বিদেশি দ্রব্য বর্জন আন্দোলনকে দেওয়া হলো মর্যাদা। মৃন্ময়ী মাটির দশাস্ত্র তৈরি হলো লোহা আর তামায়। প্রতিমার গায়ে উঠলো কোনো ইমিটেশন বস্ত্র বা শোলার গয়নাও নয়,মানে ডাকের সাজও নয়। কারণ এই সাজের দ্রব্যাদি তখন আসতো বিদেশ থেকে ডাক মারফত। তাই এর নাম ডাকের সাজ।
প্রতিমার সম্পূর্ণ পোশাক তৈরি হলো মাটি দিয়ে। দুর্গা হলো মৃন্ময়ী। মাটির। পুরোপুরি রণসাজ। শাসকের তো চক্ষু চড়কগাছ!কাদের মাথায় ভেঙে পড়লো বাজ?

পুজোর উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবীরা হবে জড়ো।
স্বদেশ জননীর চেয়ে কে বড়ো?
শৃঙ্খলিত মা-কে মুক্ত করো।

এখনও এ পুজোয় বিদেশি কোনো পণ্য ব্যবহৃত হয় না, এটাই এ পুজোর ঐতিহ্য।

আমরা পুজোর নামে জনশক্তি গড়ি
চ্যালেঞ্জ জানাই—
শাসককে করি অগ্রাহ্য।