চারণ কবির গল্প/তমাল সাহা

অবতকের বিশেষ প্রতিবেদনঃ আজ চারণ কবি মুকুন্দ দাসের প্রয়াণ দিবস,কাঁচরাপাড়া- হালিসহরে চারণ কবি মুকুন্দ দাস

চারণ কবির গল্প
তমাল সাহা

হাসিতে খেলিতে আসিনি জগতে– তাই তো! আর কি? অগ্নিময়ী মায়ের ছেলে আগুন নিয়েই খেলবে তারা। আর কি বলেছিল? দশ হাজার প্রাণ আমি যদি পেতাম। প্রকাশ্যে সোজাসুজি বলেছিল, ছলচাতুরী কপটতার মেকী মাল আর চলবে কতদিন!
এভাবে গলা ছেড়ে কন্ঠ বিদীর্ণ করে কে গাইতে পারে গান?

মাঝি মাল্লার ছেলে হলো মুদি। আর মুদির ছেলে হল গায়ক‌ নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর দত্ত। হয়ে গেল মুকুন্দ দাস। জন্মেছিল ২২ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৮ আর মরে গিয়েছিল ১৮ মে ১৯৩৪।

মাকে ভালোবেসে স্বদেশকে বুকে আগলে রেখে গিয়েছিল গান। ১৯০৮ সাল। ১০৮ ধারায় গ্রেফতার হয়ে গেল সে। মানুষ গ্রেপ্তার হয়ে যায়‌ গানকে গ্রেফতার করবে কে? জেলও খেটেছিল, দু দুবার জরিমানাও হয়েছিল। চারণের গান বরিশাল পেরিয়ে কলকাতা, কলকাতা পেরিয়ে চলে এসেছিল কাঁচরাপাড়ায়, হালিশহরে। বিপ্লবের চরণ নিয়ে এসেছিল খ্যাপা চারণ। কি গাইলো? ছিল ধান গোলা ভরা /শ্বেত ইঁদুরে করলো সারা।

গান গেয়েছিল আমাদের ওয়ার্কশপ রোডের পাশে হরিসভা অঙ্গনে। তখন তো অঙ্গন নয়, সে এক বিশাল প্রাঙ্গণ ১৯৩০ সাল। আইন ও মানব অমান্য আন্দোলনের সময়ে সে এলো কাঁচরাপাড়ায়। প্রয়াত লেখক জগদীশ মোদক বলেছিলেন তিনি তার মায়ের মুখে কাঁচরাপাড়া হরিসভায় চারণ কবি মুকুন্দ দাসের গানের আসরের কথা শুনেছেন। যাত্রাপালা-অভিনেতা মহিষাসুর খ্যাত প্রয়াত বলহরি নন্দী বলেছিলেন, সে তো অনেক দিনের কথা, তখন আমি ছোট কিন্তু পরে জেনেছি চারণ কবি এসেছিলেন এই হরিসভা প্রাঙ্গণে। নতুন করে হরিসভা প্রাঙ্গণের ছাউনি টিনের শেখ ছাইতে আমিও তো হাত লাগিয়েছি। চিত্রগ্রাহক এবং পুরাতনী সংগ্রাহক প্রয়াত মনি ভট্টাচার্য এই কলমচিকে জানিয়েছিলেন, আমি মায়ের মুখ থেকে চারণ কবি মুকুন্দ দাসের কথা শুনেছি। মা নিজেও মুকুন্দ দাসের গান শুনতে গিয়েছিলেন এবং জানিয়েছিলেন আমার বাবা যতীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য সেই গানের আসরে উদ্যোক্তাদের একজন ছিলেন।

বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির শিষ্য হালিসহরবাসী প্রয়াত স্বাধীনতা সংগ্রামী ‘হালিসহরের মানুষ’ গ্রন্থের রচয়িতা হীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, হ্যাঁ! সে তো এসেছিল হালিসহরের দোলতলায়। জমাটি গান হয়েছিল। আমি তখন খুব ছোট।
চারণ কবি মুকুন্দ দাসের মতো দুর্ধর্ষ দুর্বার চারণ কবি এই জনপদের কাঁচরাপাড়া ও হালিশহর এসেছিলেন এবং গানের আসর বসিয়েছিলেন— এর চেয়ে সুসংবাদ আর কি হতে পারে?

যাক গে আসল কথায় আসি। হরিসভা প্রাঙ্গণে বসলো গানের আসর। বুকে ঝোলানো মেডেলের পোশাক। সেদিন কি গান গেয়েছিল সে? হৃদয়ের গান জেগে ওঠার গান– ছেড়ে দাও রেশমী চুড়ি বঙ্গনারী… নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু! একা চারণ আর তার জন্য পুলিশের বিস্তৃত আয়োজন। তখন ব্রিটিশ আমল। বিজপুর পুলিশ ভণ্ডুল করে দিল সেই গানের জলসা। তাড়া খেয়ে পালালো চারণ কিন্তু তার গান ভাসতে থাকলো কাঞ্চন পল্লীর আকাশে বাতাসে—
কে ও রণরঙ্গিনী প্রেম তরঙ্গিনী/ নাচিছে উলঙ্গিনী আসব আবেশে হায়।।