চলে গেলেন প্রখ্যাত প্রথম বাঙালি ক্যাবারে ড্যান্সার ও অভিনেত্রী শেফালি

ড্যান্সই জীবনের আরতি, শেফালি হয়ে ঝরে পড়ল

অবতক খবর,৮ ফেব্রুয়ারি: উত্তাল সত্তর দশক। আমার বাস্তব জীবনের প্রারম্ভিক পাঠ। শিক্ষা-দীক্ষার যুগপৎ বন্ধন
এই সময়েই ঘটে আমার জীবনে। বীক্ষণ না হলে কি শিক্ষণ যথার্থ হয়?

এই দশকেই আমার চেতনার স্ফূরণ। ভিয়েতনাম যুদ্ধের উত্তাপ অনুভব করেছি, উচ্চারণ করেছি– তোমার নাম, আমার নাম ভিয়েতনাম। ‌ মিছিলে হেঁটেছি, দমদম বিমানবন্দরে ম্যাকনামারা ‘গো ব্যাক’ ধ্বনি তুলে তাকে হটিয়েছি। বিমানবন্দরে ফিদেল কাস্ত্রোকে দেখেছি। তাঁর চোখে যুগপৎ বিস্ময় ও অসহায়তার প্রশ্ন শুনেছি, এত কমিউনিস্ট পার্টি কেন? নকশাল আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছি, শহীদ মিনারে কানু সান্যালকে পার্টির ঘোষণা করতে দেখেছি। নকশাল হওয়ার অপরাধে খুন হতে দেখেছি তরুণদের, দেখেছি বোমা বাঁধতে। রাত্রির অন্ধকারে কমরেডদের নজরদারি রাস্তার মোড়ে মোড়ে। কেননা এলাকাজুড়ে দেওয়াল লিখন চলছে। মালসায় ভুসোগোলা কালিতে ব্রাশ চুবিয়ে—বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস, কৃষি বিপ্লব ত্বরান্বিত করুন, ধর্মই আফিম, চীনের চেয়ারম্যান আমার চেয়ারম্যান,পাশে টেন্সিলে আঁকা মাও সে তু- এর ছবি। তখনও তিনি মাও দে জং হননি। বিপ্লব একটি উৎসব। রাজবন্দিদের জেল থেকে ছিনিয়ে আনুন– কতসব স্লোগানে ভরপুর দেয়াল। সাক্ষী থাকছে তখন সেই সব লিখনের ডিবরি জ্বলা মৃদু আলোর শিখা।

সত্তর দশক আমাদের ভালো-মন্দ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে শিখিয়েছে। শ্লীলতা- অশ্লীলতার প্রশ্নে আলোচনা করেছি।আমরা বিড়ি টেনেছি, চারমিনার ফুঁকেছি,গঞ্জিকা সেবন,মদ্যপানও শিখেছি। আমরা উৎপল দত্তের কল্লোল,তীর, ব্যারিকেড, এবার রাজার পালা যেমন দেখেছি, দেখেছি কেতকী দত্তের বারবধূ আর মিস শেফালির উদ্দাম ডান্স চৌরঙ্গি নাটকে।

তখন আমরা শুনছি টুইস্ট, বেলি ড্যান্স, ব্রেস্ট ড্যান্স। স্ট্রিপটিজের কথা কানে আসছে। আমরা নকশালবাড়ি আন্দোলনের সমর্থক হলেও চুপি চুপি আরতি দাসকে দেখেছি।

আরতি দাস হচ্ছেন নৃত্যশিল্পী। ‌কিন্তু তাঁকে বলা হয় বার ডান্সার। শিল্পীর স্বীকৃতি পাননি তিনি। উদ্দাম বেলি ডান্স আর উত্তেজনাময় টুইস্ট যে দেখেনি সে সত্তর দশকের এক পর্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

দেহের অঙ্গ বিভঙ্গ শৈলীকে বাণিজ্যিক পণ করে জীবনে বাঁচার রসদ জোগাতে হবে তা বুঝেছিলেন আরতি দাস। তাই তিনি হয়ে গিয়েছিলেন শেফালী। ‌সোদপুর নাটাগঞ্জের সেই মেয়েটি। পার্ক স্ট্রিট ফার্পোজ-বার তাঁর ড্যান্সের প্রভাতী কাল । তারপর নাট্যপাড়ার বিশ্বরূপা, রঙমহল,সারকারিনা তার দখলে চলে আসে। তাঁর নাটক দেখা মানেই ব্ল্যাকে টিকিট কাটা। ‌আর হাউসফুল শব্দটি বারবার শ্রুত হওয়া।

তিনি অভিনয় করেছেন চৌরঙ্গি, আসামী হাজির, সম্রাট ও সুন্দরী, অশ্লীল নাটকে। আর সত্যজিৎ রায় তাকে ডেকে নিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী ও সীমাবদ্ধ চলচ্চিত্রে। উত্তম কুমারের সঙ্গে পা মিলিয়ে নেচেছেন গ্ৰ্যান্ডের ফ্লোরে। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে পুজো উদ্বোধন করেছেন।অভিনয় করেছেন বিকাশ রায়, অনুপ কুমার, তরুণ কুমার রবি ঘোষ প্রমুখের সঙ্গে।

শোর, মনোরঞ্জন,মেরে হুজুর, লাল পাত্থর, গাওয়ার, কলগার্ল হিন্দি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন তিনি।

আরতি দাস জীবনকে আরতি করেছিলেন নৃত্য শিল্প দিয়ে। কিন্তু শেফালি হয়ে ভোরে ঝরে পড়া শিউলির মত জীবনকে তর্পণ করলেন বারডান্সার হয়েই, , পেলেন না নৃত্যশিল্পী বা অভিনেত্রীর স্বীকৃতি।

জীবনের প্রান্তিকে এসে কি করে অস্বীকার করি আমরা কয়েকজন নকশালপন্হী তার বেলি ডান্স- স্ট্রিপটিজের উত্তেজনার মহিমা অনুভব করেছিলুম,তাকে দেখেছিলুম। স্তব্ধ পায়ে নাচ থামিয়ে তিনি চলে গেলেন ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০।

এই গর্বটুকু তো করতে পারি,প্রথম বাঙালি ক্যাবারে ড্যান্সে সহজাত নৈপুণ্যে বিশিষ্ট এক শিল্পী ও অভিনেত্রী শেফালি।
আমরা তাঁকে মুখোমুখি দেখেছিলাম এবং বিস্মৃতও হয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর মৃত্যু সংবাদ শুনে সামনে চলে এলো ধূসর স্মৃতি।