চলে গেলেন শহরের সেই পুরনো চর্মকার ভগীরথ রাম।

অবতকের বিশেষ প্রতিবেদনঃ

ভগীরথ চাচা মারা গেছে। ভগীরথ চাচার বয়স হয়েছিল। শ্বাসকষ্টে মারা গেছে। শেষ বয়সে গায়ে শ্বেতিরদাগ দেখেছিলুম। আমাদের ফুটবল থেকে চটি জুতো সেলাই করে দিত ভগীরথ চাচা।

ভগীরথ রাম/তমাল সাহা

লেনিন সরণি। চওড়া রাস্তা। পথের পাশে মাঝারি উঁচু পাতা ঝাপড়ানো একটি বটগাছ। নিচে ছায়া। তবুও একটি ছেঁড়া ছাতা খোলা। তার তলায় এক চর্মকার, প্রায় বুড়ো মতো দেহাতি মানুষ। চোখে সুতো দিয়ে বাঁধা চশমা। পাশে চায়ের পুরনো একটা বাক্স। কিছু সারাইকরা জুতো তাতে রাখা আছে। টুকরো-টাকরা বিভিন্ন রঙের চামড়া সাজানো আছে এলোমেলোভাবে বাক্সটার তাকে।

 

হাঁটু ভেঙে বসে আছে চর্মকার। ওই যে বলে না জাতে মুচি-চামার ছিল। আমি চাচা বলে ডাকতুম।ছেঁড়া চটি সেলাই করছে। সুতো ফেরানোর সুচ,হাতের সুচে লাগানো টায়ার থেকে বের করে আনা নাইলন-সুতো। ডানদিকে পেরেক, হাতুড়ি, কৌটোয় রাবার সলিউশন।

হাতের কাছেই পড়ে আছে যন্ত্রপাতি– কাঠের চাক্কি, শান পাথর, বাটালি, আর বিখ্যাত সেই তেপায়া লোহার লাস।আসলে এটা একটা নেহাই। এতে জুতোর বিভিন্ন অংশ রেখে বা ঢুকিয়ে হাতুড়ি বা লহঙ্গার দিয়ে পেটাই করে ভগীরথ চাচা মজবুতির জন্য।

আরো আছে, চামড়া টেনে টান টান করবার জন্য পিনচিস, পেরেক তোলার জন্য জাম্বুরা, চামড়া কাটবার জন্য বাটালি ও নাইফ।

লাল কালো সু পালিশ তো আছেই, আছে শাইনিং পালিশ, ব্রাশ আর ক্রিম পালিশের শিশি। ফুটবল খুব ভালো সেলাই করতে পারতো চাচা আমার।

আমি বলি, তুমি চর্মকার। ভগীরথ চাচা ততবার বলে হামি চামার! সন্ত্ রুইদাস হামার গুরু বা।

আমি আবার বলি, চর্মকার মানে জানো? চামড়ার কারুকাজ ওস্তাদি যারা জানে, তারা চর্মকার। চামার শব্দটি মর্যাদাহানিকর।

সে বলেই চলে,হাম লোগ চামার বা,উ সব ওস্তাদি নেহি জানতা। হাম টুটা ফাটা জুতা চপ্পল সেলাই করত বা।

আমি বলি,এমএলএ, মন্ত্রীর জুতো কোনোদিন সেলাই করেছো? সে ফোকলা দাঁতে হেসে ফেলে।

ভগীরথ চাচা আমাকে বলে, তু তো বুরবাক বা,উ লোগ হরবখত নয়া জুতা পেহেনত বা,উ লোগ থোরা টুটা ফাটা হোনে সে জুতা ছোড় দেতে। অউর এমএলএ মন্ত্রী কঠো বা?

উ লোগোকা ভরসা মে হামার দিন চলে ক্যায়া?

ই সব আম আদমি হামার ভরসা বা,জ্যায়দা আদমি জ্যায়দা ছিঁড়া ফাটা জুতা,জ্যায়দা কাম!

মেরা জ্যায়দা পয়সা নেহি চাহি তো,ছোটা পেট,ছোটা ভুখ।

ই সব আম আদমির ছোটা ছোটা টুটা ফাটা জুতা সিল কে থোরা মজুরি মে মেরা পেট ভর জাত বা। হামার গাড়ি,বাড়ি,আয়েস নেহি চাহি,দু বখত রোটি কে লিয়ে প্যায়সা কামাই কর লে,উ বহুত হ্যায়।

ম্যায় চামার হুঁ,ম্যায় চামার– সেই কন্ঠস্বর এখনো বটগাছের পাতা ছুঁয়ে বাতাসে ভেসে যায়।

ভগীরথ চাচার দেহ জ্বলে উঠলো ভাগীরথীর পারে অগ্নিক্ষরা চুলায়…