আজ দশমী। শুভ বিজয়া। সবাইকে অবতক- এর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা

বিশেষ প্রতিবেদনঃ

কাদের মেয়ে কৈলাস থেকে এসে ফিরে গেলে গো ? 

সুনীল আকাশ এক বুক পেঁজা তুলো মেঘ ও হিরন্ময় রোদকে নিয়ে কোন ধর্ম পালনের জন্য মাটির দিকে উপুড় হয়ে আছে? মুসলিম পাড়ার গোরস্থানের মাঠে যেমন কাশ ফুল ফুটেছে শ্মশান খোলার গাঙ্গেয় তীরেও তেমন কাশ ফুল ফুটেছে কোন ধর্মের জন্যে? শিউলিতলার ফুলগুলো কোন ধর্মের কারণে শিশির মেখে আভূমে শুয়ে আছে? পদ্মদিঘি থেকে পদ্মফুল তুলে আনছে আজিম ভাই। দুগ্গাপুজোর আসল ফুল। সে রাস্তার ধারে ফুল বেচে। অকাল বোধনে সে এই ফুল বেচে সে পেটের রুজি জোটাবে।

আকাশ, মেঘ, রোদ, কাশ, শিউলি, পদ্ম– এরা কোন জাতের,কোন ধর্মের এ প্রশ্ন উঠতেই এক্সপ্রেসওয়ের ধারে মুসলমান পাড়ায় ইমানুল জেঠু বলে উঠলো, পুরুত মশাই কলাবৌ স্নানের সময় কখন? আমরা তো মথুরা বিলে যাব স্নানযাত্রার জন্য।

পুজো কমিটিতে মুসলিমদের প্রাধান্য বেশি। প্রেসিডেন্ট ইমানুল জেঠু,, ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আজিজ, সেক্রেটারি জয়দেব কাকু,যুগ্ম সম্পাদক আল মামুন কাকু ওঃ মন্টু কাকু, ক্যাশিয়ার ইরফান দা।

 

সেটা কোন কথা নয়, কথা হল এই পুজোর এবার সুবর্ণজয়ন্তী। মুসলিম পাড়ায় হিন্দু দুর্গোৎসবের পঞ্চাশ বছর। কে হিন্দু আর কে মুসলিম! সব একহয়ে গেল এই দুর্গোৎসবে। নাম মুসলমান পাড়া হলে কি হবে প্রচুর হিন্দু পরিবার এখানে রয়েছে। ‌

 

ইমানুল জেঠু এগিয়ে এসে বললে, ওরে জয়দেব, নবপত্রিকার সব গাছ আনা হয়েছে তো? এই বলে তিনি কড় গুণে আওড়াতে থাকলেন, এক) কলাগাছ তো দেখছিই,গড়নটা ভালোই এনেছিস। দুই) কচু গাছ,তিন) হলুদ গাছ, চার) জয়ন্তী গাছ, পাঁচ) বেলগাছ,ছয়) ডালিম গাছ,সাত) অশোক গাছ,আট) মান গাছ, এই গাছকেই অমল তাস বলে,নয়) ধান গাছ। আরে আমরা চাষাভুষো মানুষ। নবপত্রিকার পুজো শুদ্ধ মনে করতে হবে। এই পুজোর মাধ্যমেই মণ্ডপে মায়ের আসল অধিষ্ঠান হয়। দেখি ইমানুল জেঠু সব জানে। বলে চলে, দুর্গা মা হলো সর্বজয়া, শস্যের দেবী।আর শস্য না হলে আমাদের পেট চলবে কেমন করে? কলা বউ কিন্তু গণেশের বউ না। নবপত্রিকা মানে নটি পাতা। এরা হল মায়ের নটি রূপ। জয়দেব কাকু আর তার সহযোগী ফরিদ, হামিদ ওমায়েদ, পিন্টুরা কান খাড়া করে সব কথা শুনল। জয়দেব কাকু তো লিডার বলে উঠলো, সবই এনেছি দাদা।

 

পুজোর জোগাড়ে বসে পড়ল শাহেদা, রোশেনারা,জাহানারা আরতি, পুতুল। তারা পুরোহিতের সঙ্গে এই কদিন থাকবে।ফলমূল প্রসাদী সাজাবে, প্রদীপ জ্বালবে, ধুনুচি জালাবে।

 

সন্ধিপুজোর দিন তো অঞ্জলির এক এলাহি কান্ড। ১০৮ টি প্রদীপ জ্বলবে। হিন্দুশাস্ত্র-মন্ত্র উচ্চারিত হবে। উচ্চারণ করবে পুরোহিত। ‌ শাহেদা শিশিরকে বলে, তোমাদের মন্ত্রধ্বনিগুলো শুনতে খুব ভাল লাগে। কি মন্দ্রকন্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ! —আবার আমাদের মন্ত্র কি? শিশির বলে ওঠে। মন্ত্র মন্ত্রই! তা আবার আমার তোমার হয় নাকি? হিন্দু-মুসলমানের হয় নাকি? তুমি আর আমি এই যে পাশাপাশি দাড়িয়ে আছি, তুমি আমার হাত থেকে ফুল- বেলপাতা নিয়ে অঞ্জলি দিলে তাতে হিন্দু মুসলমানের কি হল!

 

এবার মুসলমান পাড়ার থিম ‘সৃজনী”। মায়ের পোয়াতি অবস্থা থেকে গর্ভযন্ত্রণা এবং সন্তান প্রসব পর্যন্ত দেখানো হচ্ছে মন্ডপে। আর তারপর প্রজন্ম লালন পালনের লড়াই। স্তন্যদান থেকে শুরু করে ৫ বছর পর্যন্ত শিক্ষা জগতে প্রজন্মকে পৌঁছে দেবার মাতৃযুদ্ধ।

 

চার দিন সে কি খাবার ধুম! সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত গেট টুগেদার। তখন কত কলরব, কথাবার্তা। নিজেদের মধ্যে ভালবাসার ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা চলে। সপ্তমীর দিন তো পুরো মুসলমানি খানা। সকালে লাচ্ছা পরোটা, সবজি, ফিরনি। দুপুরে ভুনা খিচুড়ি, টাকি মাছের ভর্তা,ইংলিশ মাছ,সিমুই পায়েস।

 

আর সপ্তমীর রাতে ধুনুচি নাচের প্রতিযোগিতা।এই লড়াইয়ে বরাবরই ফরিদ যেমন ফার্স্ট, তেমন অষ্টমীর দিন ঢাকবাদন প্রতিযোগিতায় শিশির সবার আগে। সায়েদার মুখে হাসি আর দেখে কে! আর সপ্তমীর দিন! ফরিদের কাছে এক দৌড়ে চলে গিয়েছিল আরতি। ‌ তার ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, কী দারুণ নেচেছো তুমি ধুনুচি নিয়ে! এ কী আগুন নিয় খেলা!

 

দশমী আসে। সকলেই মনমরা। পাড়াসুদ্ধ সকলেই জড়ো হয়ে আছে মণ্ডপে। ‌ সিঁদুর খেলা। মা মেয়েদের মুখ সব সিঁদুর বর্ণা। লুকানো ভালোবাসার মুখগুলি পরস্পরকে দেখে। মেয়েদের সে এক অপরূপ সাজ। মনভোলানো গর্বিত সাজ।

 

‌আর তারপর?তারপর তো চোখের পালা। চোখ থেকে চিবুক বেয়ে জল গড়ায়। মা বিসর্জনে যায়। ‌ মথুরা বিলের জলও টলমল করে ওঠে। মা- আম্মু চলে যায়।হিন্দু-মুসলমান কোথায়?

 

মানবী চলে গেল। মানুষেরা গরান কাঠৈর কাঠামো কাঁধে ছলছল চোখে ফিরে আসে দুর্গাদালানে। আবার মা আসবে পরের বছর। মানুষ ফিরে আসে আলিঙ্গনে। সে এক দৃশ্য! বাংলার মুখের উপর আলো ফেলে চন্দ্রমা। বিশাল জনসমাবেশের ছায়া পড়ে মাটির উপর। পুজো বেদিতে এখন মাটির একটি চিরাগ জ্বলছে, কাঁপছে তার নিভু নিভু শিখা।