পুরাতনী গাথা– অবতক – এর বিশেষ প্রতিবেদন

রথের ছবি মানেই যুদ্ধরথ।
তীর বর্ষণ আর রক্তক্ষরণ।
কুরুক্ষেত্রের হিংস্র আয়োজন
মল্ল-গদাযুদ্ধ—
উন্মত্ত যুধিষ্ঠির দুর্যোধন।
বীর মানেই সব্যসাচী অর্জুন,
সারথি শ্রীকৃষ্ণ–কৌটিল্য নিপুণ।
ছিন্ন মুন্ড,ভঙ্গ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ—
চতুর্দিকে অস্ত্রশস্ত্র,
উড়ে যায় হাজার হাজার বৈধব্য-বস্ত্র।

আজ রথযাত্রা। এই রথ যুদ্ধবিহীন। বলভদ্র, জগন্নাথের মাঝে বসে সুভদ্রা। পুরীর সমুদ্র গর্জনে ভীত সুভদ্রা দুই ভাইয়ের মধ্যে লুকায়। এখন শত শত লক্ষ সুভদ্রা ধর্ষণের ভয়ে পালায়। কোথায় জগন্নাথ,বলভদ্র—হলধর?
সুভদ্রা কাতরায় শোকগ্ৰস্ত পাথর।

কাঁচরাপাড়া জুড়ে আজ ছটি রথযাত্রা। গ্ৰাম কাঁচরাপাড়া, কাঞ্চনপল্লীর বহু প্রাচীন রথ। কৃষ্ণরাই জীউর মন্দিরের সামনে রথের মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আগে রথটি ছিল কাঠের। সেটি কোন কারণে পুড়ে যাওয়ায় কাঞ্চনপল্লী সংলগ্ন কেউটে গ্ৰামের ধনবান বীরেশ্বর নন্দী পরিবার থেকে এই লৌহরথ নির্মাণ করে দেওয়া হয়। যেটি বর্তমানে দেখা যায়। তবে প্রতি বছরই স‌ংস্কার করা হয় রথযাত্রা কমিটির পক্ষ থেকে।
বহু প্রাচীন অর্থাৎ ১৭৮৫ সালে নির্মিত শ্রী শ্রী কৃষ্ণরাই জীউর মন্দির এই স্থানে থাকায় রথের মেলাটি প্রাচীনত্বের দিক থেকে একটি ক্ষেত্র ইতিহাস হয়ে গেছে। রথযাত্রা দর্শনকারীরা রথের মেলা দেখতে এসে অতিরিক্ত পাওনা হিসেবে এই মন্দিরটির পুরাকীর্তি দেখেই বিস্মিত হবেন।

পরবর্তীতে কাঁচরাপাড়া পৌরসভার অন্তর্গত মল্লিকবাগ মৌজার মিলননগরে রথেরমেলা পরিচালনা করেন অঞ্চলের ১০ নং ওয়ার্ডের মিলন নগর অধিবাসীবৃন্দ ও ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন। রথের মেলা শুরু হয় স্বাধীনোত্তর পর্বে–১৯৪৯ সালে।
মেলাটির প্রাচীনত্ব ৭০ বছর।এই রথের প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মী নারায়ণ জিউ মন্দির। এই রথ নির্মাণ যুক্ত ছিলেন ধনবান বীরেশ্বর পাল এবং কাষ্ঠ-শিল্পী নিবারণ দাস,সুরেশ দাস, সাধন সরকার, দেবেন ঠাকুর প্রমুখ।এখানে রথের উচ্চতা ১৫ ফুট। এই মেলা সংলগ্ন অঞ্চলেই রয়েছে ঐতিহাসিক বাগের মসজিদ।এটি নির্মিত হয়েছিল শায়েস্তা খাঁ-এর আমলে। মেলা দর্শনার্থীদের কাছে এটিও একটি দ্রষ্টব্য মসজিদ।

কাঁচরাপাড়ায় আরেকটি রথ অনুষ্ঠিত হয় লিচুবাগান অঞ্চলে। এটিও কাষ্ঠ নির্মিত রথ। ১৯৬৯ সালে এটির মূল উদ্যোক্তা ছিলেন মালতী মালাকার নামে এক মহিলা। তিনি১৯৭০ সাল পর্যন্ত খেলনা রথ নিজে টেনে নিয়ে পথ পরিক্রমায় নেমে পড়তেন। পরবর্তীতে তিনি অঞ্চলের শুভাকাঙ্ক্ষী হরিসাধন দে, নারায়ণ ভদ্র, দীনেশ মন্ডল, অবিনাশ দে, রমেশ দে,পরেশ দে প্রমুখের সঙ্গে আলোচনা করে রথযাত্রার বৃহৎ আঙ্গিক রূপায়ণ করেন। ২২ ফুট উঁচু কাষ্ঠ নির্মিত এই রথ। নিমকাঠ নির্মিত দুটি ঘোড়া রথটির সঙ্গে সংযুক্ত। পাথর ও সিমেন্টের মাধ্যমে বিগ্রহ তিনটি নির্মাণ করে দিয়েছেন শিল্পী সুধীর মুখার্জী। বর্তমানে রথ-উৎসব আয়োজনের মূল ভূমিকায় রয়েছেন বল কুন্ডু, রনি দে, শুভঙ্কর দে, সহদেব দে,রমেশ দে, পরেশ দে, তারক ঘোষ প্রমুখ। মেলা পরিচালনায় সহযোগিতা করে স্হানীয় ক্লাবগুলি— নবাঙ্কুর, পান্নালাল স্পোর্টিং, লিচুবাগান যুবকবৃন্দ।তবে বহু বছর ধরেই মূল দায়িত্বে রয়েছে নবাঙ্কুর।

২০০৬ সালে কাঁচরাপাড়া কলেজ সংলগ্ন অঞ্চলে শুরু হয় একটি রথের মেলা। ছোট্ট শিশুদের খেলনা রথ দিয়ে এই রথযাত্রার সূচনা। পরবর্তীতে রাজনৈতিক দল তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর ২০১১সাল থেকে সেটি সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। বিশেষভাবে এই রথের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন ৮ নং ওয়ার্ডের সিরাজ মন্ডল রোড,নিরঞ্জন সেন পল্লীর অধিবাসীরা।

অ্যাডভোকেট বাসুদেব মজুমদার নিজ উদ্যোগে ২০১৮ সাল থেকে একটি বর্ণময় রথযাত্রার সূচনা করেছেন।‌পশ্চিমবঙ্গে এটি একটি উল্লেখযোগ্য রথ উৎসব হতে চলেছে। এখানে বলভদ্র, জগন্নাথ, সুভদ্রা তিনটি পৃথক রথে অধিষ্ঠান করেন। প্রতিটি রথের উচ্চতা ৬ ফুট। নিম কাঠের তৈরি। দেবতার তিনটি মূর্তিও নিমকাঠের তৈরি। জগন্নাথ দেবের এখন ১৩৯জন বংশধর রয়েছেন। সেই বংশোদ্ভূত গৌতম দৈত্যাপতির তত্ত্বাবধানে এই রথ ও বিগ্ৰহ মূর্তিগুলি পুরীতে নির্মিত হয়। এই মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পুরী থেকে আগত পঞ্চ উড়িয়া পন্ডিত। বাসুদেব মজুমদার জানান,এই রথযাত্রার পথ কুমোরপাড়া থেকে বাগমোড় হয়ে হালিশহর পৌরসভার মূল সিংহদ্বার পর্যন্ত এবং ওই পথ ধরেই কুমোরপাড়ায় প্রত্যাবর্তন। তিনি বলেন, এই রথের বৈশিষ্ট্য তিনটি পৃথক রথে তিনটি মূর্তির অবস্থান। পশ্চিমবঙ্গের কোথাও এইভাবে রথযাত্রার প্রচলন নেই।

২০১৯ সাল, এবছর প্রথম সূচনা হচ্ছে মান্ধারী বাজার রথযাত্রা উৎসব। ১৫ নং ওয়ার্ড রথযাত্রা উৎসব কমিটির দ্বারা এবং অন্যান্য রথপ্রেমীদের সহযোগিতায় এই রথযাত্রা আয়োজিত হচ্ছে। এখানে বলভদ্র, জগন্নাথ ও সুভদ্রার ছটি মূর্তি আনা হয়েছে। তিনটি নিমদারু নির্মিত এবং অন্য তিনটি পাথরে নির্মিত। সব মূর্তি পুরী থেকে আনা হয়েছে। নিমদারু নির্মিত মূর্তির উচ্চতা ৩৩ ইঞ্চি এবং পাথুরে মূর্তির উচ্চতা ১৮ ইঞ্চি। এখানে লৌহ নির্মিত রথের উচ্চতা ১৬ ফুট। ২৯শে জুন নবযৌবনবেশ অমাবস্যায় মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন পুরী থেকে আগত পঞ্চ পুরোহিত প্রশান্ত কুমার আচার্য্য, রমেশ চন্দ্র শথপথী, প্রদীপ চন্দ্র আচার্য্য,সুদাম চন্দ্র মিশ্র এবং প্রভাত দাস। সংলগ্ন অঞ্চলে রয়েছে সুপরিচিত রামঠাকুরের লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির। সম্পূর্ণ পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরের আদলে ও সম উচ্চতায় নির্মিত এই মন্দির। অঞ্চলে এটি অন্যতম দর্শনীয় দেবালয়।

মনে পড়ে গেল কাঁচরাপাড়ার পুরাতন ঐতিহ্যের কথা। কাঁচরাপাড়ার একসময়ের ঐতিহ্য ছিল পাল বাড়ির রথ। স্টেশন রোডে রাখাল চন্দ্র পালের রথ। সেই বিশাল রথটি ছিল সম্পূর্ণ পিতল ধাতুর তৈরি।

রথযাত্রা লোকারণ্য,মহা ধুমধাম বহুল প্রচলিত কবিতা। এই রথযাত্রার মাহেশের রথকে কেন্দ্র করে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন সেই মহতী প্রেমের উপন্যাস ‘রাধারাণী’ এবং পরবর্তীতে রথযাত্রা পরিদর্শন করেই রবীন্দ্রনাথের সৃজন ক্ষমতার স্ফূরণ আমরা
দেখেছি তাঁর ‘রথের রশি’তে— সেখানে ঘোষিত হয়েছে শ্রমিষ্ঠ মেহনতি মানুষের সংহতি ও জয়।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন,
ওই যে চাকা ঘুরছে ঝনঝনি, / বুকের মাঝে শুনছ কি সেই ধ্বনি।/ রক্তে তোমার দুলছে না কি প্রাণ।/ গাইছে না মন মরণজয়ী গান?/আকাঙ্ক্ষা তোর বন্যাবেগের মতো ছুটছে না কি বিপুল ভবিষ্যতে।