আজ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর জন্মদিবস

কাঁচরাপাড়া কি ক্ষুদিরাম ছাড়া বাঁচে?

তমাল সাহা

ক্ষুদিরাম বারুদ বালক। আমাদের স্বাধীনোত্তর এই দেশে ক্ষুদিরাম এখনও সন্ত্রাসবাদী বলে উল্লেখিত। তমু বলে,সন্ত্রাসবাদী কেন জঙ্গী বললেই বা আমাদের কি আসে যায়! বোমারু বিমান যদি হতে পারে বোমারু ক্ষুদিরাম হতে দোষ কোথায়? স্বজাত্যবোধে উজ্জীবিত এমন কোন বাঙালি নেই বা বিপ্লবী সত্তায় আচ্ছন্ন এমন কোন মনন নেই যে ক্ষুদিরামকে ভালোবাসে না! কাঁচরাপাড়া স্মরণ করে ক্ষুদিরামকে।

তাঁর নামকে স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাতে ব্রিটিশ নির্মিত স্পলডিং ইন্সটিটিউটের নামকরণ করা হয়েছে ক্ষুদিরাম বোস ইনস্টিটিউট। তমু অনুসন্ধানে জেনে ছিল ব্রিটিশ আমলে তিনটি ইনস্টিটিউট ছিল। কেরানি বাবুদের জন্য হাইন্ডমার্শ, সাহেবসুবোদের জন্য বেল।আর এই ইনস্টিটিউটটি ছিল কামগারি মানুষদের রিক্রিয়েশন ইনস্টিটিউট। এটি গড়ে উঠেছিল ১৮৯২ সালে।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে

এই ইনস্টিটিউটের মূল‌ ফটকের সামনে একটি বেদী নির্মিত করে ক্ষুদিরামের আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়। এই মূর্তিটি উন্মোচিত হয়েছিল ৯ই সেপ্টেম্বর, ১৯৮১। এটি উন্মোচন করেছিলেন জাফর শরিফ, রাষ্ট্রমন্ত্রী কেন্দ্রীয় রেল দপ্তর। ইনস্টিটিউটের নাম পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন রাজনৈতিক কর্মী সুপরিচিত মৃণাল সিংহরায়।

দীর্ঘ ছ বছর আগে এই ইনস্টিটিউট পুনঃসংস্কারের সময় মূর্তিটি ভেঙে ফেলা হয়। কেন ভেঙে ফেলা হল তাও তমু জানেনা। ছোট্ট আবক্ষ মূর্তিটি খুব সহজেই স্হানান্তরিত করা যেত। প্রশাসন তো বটেই রাজনৈতিক দলগুলোও কেন গুরুত্ব দেয়নি আজও তা রহস্যজনক। দীর্ঘদিন ভূতলে এই মূর্তিটি গড়াগড়ি খেতে থাকে।

বিজপুর মুখোমুখি– স্থানীয় সংবাদপত্র ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং প্রতিবাদ জানিয়ে বিষয়টি জনসমক্ষে আনে। পরবর্তীতে ১১ আগস্ট,২০১৯ মূর্তিটি নতুনভাবে স্হাপন করে পুনর্মর্যাদা দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ।

এই স্পলডিং ইন্সটিটিউট তথা ক্ষুদিরাম বোস ইনস্টিটিউটের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। এই ইনস্টিটিউটটি কাঁচরাপাড়ার বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এবং এটি হেরিটেজ হিসেবে ঘোষিত হতে পারে।

১৯৪৭ সাল,১৫ই আগস্ট কাঁচরাপাড়ায় যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল, শান্তি কমিটির আহ্বানে মহাত্মা গান্ধী সুরাবর্দিকে নিয়ে এই স্পলডিং ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় আসেন এবং শান্তি রক্ষার্থে ভাষণ দেন ১৯ আগস্ট,১৯৪৭।

কলকাতার নাট্যধারা অনূযামী ১৯৬০ সাল জানুয়ারি মাস থেকে টানা দু’ বছর নিয়মিত অভিনয় হয়েছিল এই মঞ্চে তুলসী লাহিড়ীর লেখা সেই বিখ্যাত নাটক ‘ছেঁড়া তার’। আয়োজক ‘আর্ট থিয়েটার’! পরিচালক ছিলেন সুনীল মুখার্জী। তখনকার ডাকসাইটে কুশীলবরা ছিলেন সু্ধীর ব্যানার্জি,ননী দে, সুবোধ সরখেল, কার্তিক কুণ্ডু,কালি ভৌমিক,কেষ্ট ব্যানার্জি,অনিল মুখার্জী,ইন্দু মণ্ডল প্রমুখ।

১৯৬১ সালে সেই নিয়মিত অভিনয় দেখে যান ‘নবান্ন’ খ্যাত সুধী প্রধান, সঙ্গে তুলসী লাহিড়ীর পুত্র হাবু লাহিড়ী এবং প্রবোধ বন্ধু অধিকারী।

১৯৭৬,১৯শে মার্চ এই ময়দানেই মহানায়ক উত্তম কুমার সংবর্ধিত হন।

১৯৮৭-র মার্চ এই ময়দানে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী নির্বাচনী বক্তব্য রাখেন এবং তার বঙ্গানুবাদ করে দেন প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী।

৭ মার্চ,১৯৮৬ সালের সেই ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক আয়োজন যা আটটি গেট পেরিয়ে ঢুকতে হয়েছিল অনুষ্ঠান স্থলে সেখানে একের পর এক প্রাণময় সঙ্গীত পরিবেশন করে গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না গায়িকা লতা মঙ্গেশকর।

এদিকে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া- হরিণঘাটা- গয়েশপুর, গঙ্গার ওপারে হুগলি থেকে বেলা বারোটা থেকে শ্রোতারা এই অনুষ্ঠান শোনার জন্য মাঠে উপস্থিত হতে থাকেন। মাঠে তিল ধারণের স্হান ছিল না।এ এক যুগান্তকারী ঘটনা।

আশা ভোঁসলে, রাহুল দেব বর্মন, মান্না দে-র মতো সঙ্গীতকারদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ঘটেছে এই ইনস্টিটিউট ময়দানে।

আর কার অনুরোধে লতাজি অনুষ্ঠান সমাপন করেছিলেন,কোন গান দিয়ে? বিশেষ অনুরোধ করেছিলেন মৃণাল সিংহরায়। আর গানটি ছিল সেই বারুদ বালক ক্ষুদিরামকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। সেই গান বাংলার লোক-গণসঙ্গীত হয়ে গিয়েছে—

‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি…..

হুলুস্থুল করতালিতে অভিনন্দিত হয়েছিলেন তিনজন— গানটি নিজে, লতাজি আর মৃণাল সিংহরায়।

এর সমস্ত কৃতিত্ব পেতেই পারে একজন তিনি হলেন এই ইনস্টিটিউট —– ক্ষুদিরাম বোস নামাঙ্কিত এই ইনস্টিটিউ।