লেনিনের জন্ম হয় প্রতিদিন।
কাঁচরাপাড়ায় লেনিন এসেছিলেন একদিন!

কাঁচরাপাড়ায় লেনিন
তমাল সাহা

সেটা ছিল ১৮৬৩ সাল—
বিশাল ব্লাস্ট ফার্নেসের মাথায় মোটা চিমনি বেয়ে উঠে যাচ্ছে কালো ধোঁয়া।
কখনো সঙ্গে বেরিয়ে আসছে জিভ বার করা আগুন। বেলচা-গাঁইতির শব্দ,কয়লা-চুনাপাথরের রাসায়নিক ‌
আর ঘামের লবণের একটা জঙ্গি মেহনতের গন্ধ ছুটে যাচ্ছে দুর্ধর্ষ বাতাসে।
হাতুড়ির দমাদম শব্দে রিভিটের পর রিভিট সেঁটে বসেছে লোহার প্লেটে
মেজাজি হয়ে উঠছে স্টিম ইঞ্জিন—
তামাম কারখানা জুড়ে মজদুরি উল্লাস। ‌

১৮৯৭ সালের মে মাস—
লেনিন তখন নির্বাসনে সাইবেরিয়ার শুশেনস্কয় গ্ৰামে।
চিঠি লিখে পাঠালেন লালখামে
কাঁচরাপাড়ার রেলওয়ে শ্রমিকদের কাছে।

দিন যায়, মাস যায় বছরও ঘুরে গেল সূর্যের প্রহারে।
এবার লেনিন নিজেই এলেন— কাঁচরাপাড়ায়।
ওয়ার্কশপ রোড খুঁজে খুঁজে হন্যে হয়ে গেলেন।
ভাবলেন কোথাও ভুল হচ্ছে না তো!
শ্রমিকরা তো এমনই ঠিকানা দিয়েছিল।
তারপর কারখানার হদিশ করতে করতে যখন ঘেমে নেয়ে উঠলেন,
তখন একটা দেশি মদের দোকানের সাইনবোর্ডে দেখলেন লেনিন সরণি— ব্রাকেটে লেখা ওয়ার্কশপ রোড।

বেচারা লেনিন!
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন—
ওয়ার্কশপ রোড নাম বদল করে এরা রেখেছে লেনিন সরণি?
ওয়ার্কশপের চেয়ে লেনিন বড়?
রবীন্দ্রনাথের দেশেও এসব হয়?— বলতে বলতে আনমনা হয়ে গেলেন লেনিন।

খুঁজে তো পেলেন।
পুলিশ ফাঁড়ির পাশ দিয়ে
কালীমন্দিরের গা ঘেঁষে সোজা চলে গেলেন।
কারখানার শেডের মাথায় চিমনি দেখে
লেনিন সোজা ঢুকে গেলেন চার নম্বর লোকোশেডের ঢালাই ঘরে।
তখন গেটে খাকি উর্দিপরা সেপাই, কালোয়ার সাকরেদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কি যেন পুরে নিল নিজের পকেটে।

চড়া রোদে ঘামছিলেন লেনিন—
বাঃ, ভালোই হলো!
এখানে এসে শরীরটা জুড়ালো। ‌এখানে বেশ ঠান্ডা তো!
হঠাৎ সম্বিত পেলেন লেনিন—
ঢালাই ঘর এত ঠাণ্ডা কেন?

লেনিন কি দেখলেন?

ফার্নেস ডাইনোসরের মতো পড়ে আছে।
কবেই নিভেছে আগুন, ‌কামগার নেই।
কালো ঝুল, গাঢ় অন্ধকার আর নৈশব্দ্যের প্রগাঢ় মহিমা—
সার সার ঝুলে আছে অসংখ্য বাদুড়। ‌
কারখানার ফাটা-ফুটো টিনের চালের ফ্রেমে।

লেনিন কি দেখলেন?

কারখানার চত্বরেই গজিয়ে ওঠা চায়ের গুমটিতে
ছাপ্পামারা নেতারা গল্প জমিয়ে দিয়েছে।
আঙুলের ফাঁকে পুড়ে যাচ্ছে তামাকের লম্বা টান—তখন বেলা নটা।

লেনিন কি দেখলেন?

পাঁচটি ট্রেড ইউনিয়নের ছাউনি।
শ্রমিক চেতনা কি গেছে এতোই বেড়ে?
একটি ইউনিয়নে যাচ্ছেনা সামলানো?
তবে কি ক্ষমতা দখল আসন্ন হয়ে এলো এখানে?
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!

লেনিন কি দেখলেন?

পেতলঘর বন্ধ, এশিয়ার বৃহত্তম করাত ঘর বন্ধ, ওয়র্কলোড তলানিতে—
কাম ‌কে লিয়ে লড়াই ভি বনধ।
সদর দপ্তরে উঁকি মারলেন তিনি—
নোকরি, প্রমোশন আর পয়সার একসঙ্গে জমাটি আড্ডা কর্তা সাহেবের কামরায়।
তিনজন শ্রমিক বেআইনি বদলির নোটিশ পেয়ে গেছে শনিবার বিকেলে।
ট্রেড ইউনিয়ন কি করছে এখানে?

ভারতবর্ষ!
উচ্চারণ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন লেলিন।

লেনিন কাঁচরাপাড়ায় এসেছিলেন, বাইশে এপ্রিল নিরানব্বই।
প্রকাশ্য দিবালোকে তখন মন্ত্রী বারোটি জিপে
কমান্ডো পাহারায় যাচ্ছিলেন পাঁচতারা হোটেল উদ্বোধনে।
তার আগেই শ্রমিক নেতা দেশ ও হোটেল শিল্পের উপযোগিতা শীর্ষক সেমিনারে বক্তৃতা সেরে ফেলেছেন।

লেনিন এসেছিলেন কাঁচরাপাড়ায়
দিনটা ছিল বাইশে এপ্রিল, উনিশশো নিরানব্বই!