অন্য দুর্গা– নয়

এক নকশালপন্থী যুবকের দুর্গা পুজো

আবুর দুর্গা
তমাল সাহা

একটা যুবক ছিলো। বয়স হতেই একগাল দাড়ি। ডাঙ্গাপাড়ায় থাকতো রেল কেয়ার্টারে। বাড়ির থেকে অদূরে একটা বটগাছ তলায় আড্ডা দিত।

উত্তাল সত্তর দশক। সে নকশাল হয়ে গিয়েছিল। আড্ডা মানে নকশালি আড্ডা। নকশালি আড্ডা মানে রাজনৈতিক আড্ডা। রাজনৈতিক আড্ডা মানে বিপ্লব ভাবনা। দেশের আমূল পরিবর্তন ঘটানোর প্রক্রিয়া।

মাও সে তুং- এর ভক্ত ছিল সে। ওই যে দেয়ালে লেখা থাকতো– ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’। আরেকটা কথা বড় করে লেখা থাকতো–‘বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস’। আরেকটি স্লোগানও তারা লিখতো– ‘কৃষি বিপ্লব তরান্বিত করুন’। ভুসো কালিতে রাতের অন্ধকারে লম্প জ্বেলে এসব লেখা হতো।

আবু জেল খেটেছিল। তার দাদা মৃদুলের সারা শরীর বোমার আঘাতে ঝলসে গিয়েছিল। চেনা যাচ্ছিল না।

হ্যাঁ। সেই আবু। মৃণাল সিংহরায়। যে নিজের হিম্মতে হাজার হাজার যুবককে রেল কারখানায় চাকরি দিয়েছিল। কাঁচরাপাড়ায় উত্তমকুমারকে এনেছিল। লতা, আশা, রাহুল সবাইকে এনে জড়ো করেছিল ফাংশানে, জলসায়।

যাক সেসব কথা। আবু পরে কংগ্রেসী হয়ে গিয়েছিল। কংগ্রেসী না হয়ে উপায় ছিল না। কংগ্রেসী সন্ত্রাসের কথা কে না শুনেছে! বাহাত্তরের কংগ্রেসের সন্ত্রাস। সে তখন কংগ্রেসের যুবনেতা হয়ে গেলেও মনে মনে সে নকশালই ছিল। তার বুক চিরলে পাশাপাশি ক্ষুদিরাম ও বিপিন গাঙ্গুলিকে দেখা যেত।

সেই আবু। মৃণাল সিংহরায়। সেও পুজোয় ভিড়ে গেলো। ডাঙ্গাপাড়া ইউথ এ্যাসোসিয়েসন নামে সে পুজো আরম্ভ করলো আর.পি. হাই স্কুলের মাঠে। কিন্তু লোকে বলতো আবুর পুজো। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম আবুকে, কী আবু! নকশাল করে শেষ পর্যন্ত পুজোয় ভিড়ে গেলে?
তার তো ঝটতি উত্তর, আরে এ তো অস্ত্রের পুজো। দুর্গাপুজো। অন্য কোনো পুজো করছি না। লক্ষ্মী-সরস্বতী না। দশপ্রহরণীর পুজো। লোকে বুঝুক আর না বুঝুক, অস্ত্রের পুজো করেই যাবো।

সত্তর দশকে একটা রাইফেল ছিল। সেটা কার তা বলছি না, তবে একজনের বাড়িতে লুকোনো ছিল। আবার মনে পড়ে গেল– বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস।

আবুর পুজোয় দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসতো পুজো দেখতে। জেলার বাইরের বিভিন্ন জায়গা থেকে চাঁদা আসতো। ব্যবসায়ীমহল সাগ্রহে চাঁদা দিত এই পুজোয়। কারণ তাদের স্বার্থ ছিল এই পুজোর সঙ্গে। এই পুজোর জন্য কাঁচরাপাড়ার পরিচিতি নিশ্চিত বৃদ্ধি পেয়েছিল। এবং অর্থনৈতিক ভাবে কাঁচরাপাড়ার বাণিজ্যিক মহলের সমৃদ্ধিও ঘটেছিলো। কেননা অনেক রাত পর্যন্ত মানুষ ঠাকুর দেখতো। কাঁচরাপাড়া জুড়ে কেনাবেচা চলতো।

অনেক নকশাল ও কংগ্রেসীদের জড়ো করে আবু এ পুজোর আয়োজন করেছিল। ১৯৭২ সালে পুজোর শুরু। একটানা ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত চলে এই পুজো। ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের বন্যা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। খুধার্ত, বন্যাপীড়িত মানুষ আগে, না শারদ উৎসব আগে? প্রশ্ন তুলল আবু। সেবার আর পুজো করলো না। সব অর্থ তুলে দিল বন্যার্ত মানুষদের স্বার্থে।

তার প্রথম বছরের পুজোর প্যান্ডেল তৈরি করেছিল কলকাতার খ্যাতনামা মডার্ণ ডেকরেটার্স। প্রথম বছরের পরিকল্পনায় ছিল রাজবাড়ির আদল। টুনি লাইটের অপূর্ব ব্যবহারিক প্রয়োগ হয়েছিল সেবার। একবার প্যান্ডেল হয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আদলে। যেবার মন্ডপ হয়ে ওঠে বাকিংহাম প্যালেস সেবার ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়।কাতারে কাতারে গভীর রাত পর্যন্ত মানুষের কী ঢল! এই রে কোথায় যাচ্ছিস? আবুদার পুজো দেখতে। একবার বেতের কারিগরিতে মন্ডপ হয়ে ওঠে মীনাক্ষী মন্দির। মাঝখানে দীর্ঘ বছর পুজো বন্ধ থাকে অনিবার্য কারণে।

আবুর নেতৃত্বে শেষ পুজো হয় ১৯৯৬ সালে। সেবার মন্ডপ হয়ে ওঠে অক্ষরধাম।
প্রথম দুবার প্রতিমা এসেছিল কলকাতার কুমোরটুলি থেকে। পরে কৃষ্ণনগর ঘুর্ণি থেকে এসেছে প্রতিমা। রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত মৃৎশিল্পী মুক্তি পাল হয়ে ওঠেন এই প্রতিমার কারিগর। আবু হয়ে উঠেছিল তার ঘনিষ্ঠজন।

মুক্তি পালের নেতৃত্বে মাটির পর মাটি চাপিয়ে কাঠামোকে মৃন্ময়ী করে তুলতেন পটুয়ারা। যাদের অন্যতম ছিলেন গৌর পাল।

প্যান্ডেলের কাঠামো গড়তে আসতেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মথুরাপুর থেকে দুই ম্যারাপ শিল্পী– বিভূতি মন্ডল ও নৃপতি মন্ডল। সেসময় প্যান্ডেলের বিভিন্ন সামগ্রী– বাঁশ, কাপড় সরবরাহ তো বটেই তাদের কারিগরের ভূমিকায়ও থেকেছেন কখনও কাঁচরাপাড়ার দেবেশ বণিক কখনও বাসন রায়। কাঠামোর বাটামের কাজে সহায়তা করতেন পল্টন মল্লিক।

২০১১ সালের পরেও কয়েকবার অনিয়মিত ভাবে এই পুজো হয়েছিল।
এখন আর এই পুজো হয় না। কিন্তু শারদোৎসব এলেই লোকে বলে, আরে! আবুদার পুজোর কথা মনে আছে? মনে আছে আবুদার পুজোর কথা!এই হচ্ছে পুজোর স্মৃতি।

একদিন এক নকশাল অস্ত্রময়ীর পুজো করেছিল কাঁচরাপাড়ায়।