আজ ৭ এপ্রিল নাট্য-চলচ্চিত্রকার তুলসী লাহিড়ীর জন্মদিন: তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক ‘ছেঁড়াতার’ ও কাঁচরাপাড়া

আজ ৭ এপ্রিল নাট্য-চলচ্চিত্রকার তুলসী লাহিড়ীর জন্মদিন: তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক ‘ছেঁড়াতার’ ও কাঁচরাপাড়া

তমাল সাহা

স্মৃতি ধূসর হয়। জীবনের বেলা প্রান্তিকে চলে এলে সূর্যাস্তের সেই গৈরিক রঙ তার গায়ে চলে আসে। স্মৃতির বারান্দায় দাঁড়িয়ে তখন কত কথা মনে পড়ে। হঠাৎ মনে পড়ে যায় আজ ৭ এপ্রিল। তুলসী লাহিড়ী জন্মেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর ন’বছর আগে আমার জন্ম। আজ তাঁকে মনে পড়ে।

কাঁচরাপাড়ায় তখন নাট্য আন্দোলন চলছে পুরোদমে। ১৯৫০, ২৯ মার্চ প্রতিষ্ঠা হলো আর্ট থিয়েটার। ১ নং সিদ্ধেশ্বরী লেন শিবু অধিকারীর মাটির ঘরে।

স্পল্ডিং ইন্সটিটিউট মঞ্চ। ১৯৬০ সাল। জানুয়ারি মাস থেকে তখন নিয়মিত হচ্ছে তুলসী লাহিড়ীর সেই বিখ্যাত নাটক ‘ছেঁড়াতার’। ‘দুখীর ইমান’ আর ‘ছেঁড়াতার’– এই দুটি নাটকেই তুলসী লাহিড়ী জনসমক্ষে চলে এসেছিলেন। তিনি তখনকার দিনের His Master’s Voice ও মেগাফোন কোম্পানিতে কাজ করতেন।

তিনি কি না ছিলেন? বলতে গেলে হাতের কড় গুনতে হয়। সুরকার, নাট্যকার, গায়ক,নাট্য- চলচ্চিত্র অভিনেতা, পরিচালক পর পর বলে যেতে হয়। আমি দেখিনি তাকে কোনোদিন। তবে তাঁর লেখা সেরা নাটকটি ‘ছেঁড়াতার’ আমি দেখেছি। ছেঁড়াতার নাটকটি দুবছর চলেছিল কাঁচরাপাড়া স্পল্ডিং ইন্সটিটিউট মঞ্চে যা এখন ক্ষুদিরাম বোস ইন্সটিটিউট নামে পরিচিত।

গর্ব ও অহঙ্কার এই যে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে প্রথম এমন নিয়মিত অভিনয়ের উদ্যোক্তা আমাদের কাঁচরাপাড়ার আর্ট থিয়েটার। এটা একটা দেশীয় ইতিহাস বললে অতিশয়োক্তি হবেনা।

এই নাটকটির পরিচালক ছিলেন সুনীল মুখার্জি। অভিনেতা ছিলেন সুধীর ব্যানার্জী, ননী দে, সুবোধ সরখেল, কার্তিক কুন্ডু, কালী ভৌমিক, কেষ্ট ব্যানার্জি, অনিল মুখার্জি, ইন্দু মন্ডলরা। তখনকার সব ডাকসাইটে কুশীলব।

‘ছেঁড়াতার’। সময়ের গল্প, বাস্তবের গল্প, জীবনের গল্প। এ গল্প হিন্দু মুসলমানের গল্প শুধু নয়, জীবনের ছেঁড়া তারের গল্প। রহিমের দিলরুবা বাজনাটি নাটকের ভেতর জীবনকে নাচায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ— চোরাকারবারি আর কালোবাজারির কাল। সরকারি কর্মীদের আঁতাতে বেআইনি মজুত চলছে। লোভী মহাজন আর ব্যবসায়ীদের দাপট।

পঞ্চাশের মন্বন্তর মানে মহা দুর্ভিক্ষের কাল। পেটে দানাপানি নেই মানুষের। হাকিমুদ্দিনের বাড়িতে সরকারি লঙ্গরখানা। যে ঐতিহ্য এখনও চলেছে। স্বজনপোষণ আর কামাইবাজির সরকারি যোগসাজশ, কৌশল।

রহিম আর ফুলজানের গল্প। গল্পের মাঝে ঢুকে পড়ে শ্রীমন্ত। ফুলজানের দিকে হাকিমুদ্দির লালসার দৃষ্টি কামার্ত চোখ– এ গল্প বাস্তব জীবনের।

খিদের তাড়না এমন স্বামীর নিষেধ মানে না, স্বামীর আত্মমর্যাদাবোধকে অস্বীকার করে।
তাই তালাকনামা লেখাতে বাধ্য করে রহিমকে। সে ফুলজানকে রহিম তালাক দেয়। এ আত্মমর্যাদা রক্ষার গল্প।

ধূলিমলিন জীবনে দিলরুবার তার তখন ছিঁড়ে গেছে। নাটকে উত্তরবঙ্গের কামরূপী কথ্যভাষার অপূর্ব ব্যবহার নাটকটিকে গতিময় করে তুলেছে। সেই নাটকটি টানা দু’বছর অভিনয় হয়েছিল কাঁচরাপাড়ার স্পল্ডিং-এর রঙ্গমঞ্চে।

১৯৬১ সাল। সেই ভারত কাঁপানো নাটক ‘নবান্ন’ নাটকে কুঞ্জর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন যিনি সেই সুধীপ্রধান চলে এসেছিলেন এই নাটক দেখতে। সঙ্গে ছিলেন তুলসী লাহিড়ীর ছেলে হাবু লাহিড়ী এবং প্রবোধবন্ধু অধিকারী।

সেদিন সুধী প্রধান আর তাঁর সঙ্গীরা খাওয়াদাওয়া সেরে ছিলেন ননী দের বাড়ি। ননী দে কে আপনারা সকলেই চেনেন। হরিসভার উল্টোদিকে তাঁর ছিল চায়ের দোকান’ এখনও আছে। সেখানে ছিল তৎকালীন অনেক ডাকসাইটে পেশিবহুল মানুষের আড্ডাখানা।

ননী দে তখন থাকতেন রজনী বাবু রোডে পাওয়ার হাউসের পেছনে ইন্দ্রাসন মিস্ত্রির বাড়ি। সেই ‘ছেঁড়াতার’ নাটকটি দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন সুধী প্রধান।

সুধী প্রধান ছিলেন একজন সাংস্কৃতিক সংগঠক, কমিউনিস্ট কর্মী। তখন কাঁচরাপাড়া কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ছিলেন সেই দীর্ঘকায় পাতলা মানুষটি। নাম তাঁর কুঞ্জ বসু। তাঁর নামে কাঁচরাপাড়ায় একটি রোডও রয়েছে। পুরোনো পাওয়ার হাউস সেই রোডেই অবস্থিত।

এ সবই এখন গৌরববাহী আঞ্চলিক ইতিহাস।