আজ বাংলা সাহিত্যের বহুমাত্রিক মানুষ,সময়ের জাগ্রত বিবেক শঙ্খ ঘোষের জন্মদিন

অবতক- এর বিশেষ প্রতিবেদনঃ
প্রসঙ্গ শঙ্খ ঘোষ ও কিছু ক্রোধান্ধ কথাবার্তা
তমাল সাহা

রাষ্ট্রের হাতে সময় যখন বিপর্যস্ত, মানুষের নীরব আর্তরব যখন চতুর্দিকে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের তো অন্ত নেই, তার মধ্যে রাষ্ট্রের উন্মত্ত উল্লাস জনবিরোধী কার্যকলাপ, দলিত,নিপীড়িতকে শোষণ, ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক ঐক্য যখন বিনষ্ট,যুদ্ধের বিভীষিকা যখন মানবসত্ত্বাকে ধ্বংস করতে চলেছে,সেই মুহূর্তে তিনি প্রহরী এক জাগ্রত বিবেক। অক্ষরের আগুন নিয়ে দাঁড়িয়েছেন, প্রকাশ্যে তুলে ধরেছেন শব্দের জ্বলন্ত মশাল। বিপ্রতীপে হয়েছেন তিনি অপমানিত অসম্মানিত। সমস্ত কিছুকেই এড়িয়ে গেছেন তিনি। কারণ রাত্রির তমসা ভেদ করে বোধিবৃক্ষের
মতো সটান ঋজু ছিলেন তিনি। নীরবতা যেমন বৃক্ষের ধর্ম, আশ্রয় দান করাই যেন তার কর্ম। জন্ম থেকে মৃত্যু, ছায়াদান থেকে চিতা কাঠের জ্বালানি হাওয়া যার স্বভাব সেই বৃক্ষের মতো তিনি বিচরণ করেছেন এই গাঙ্গেয় উপত্যকায়। দলীয় চাপে নতি স্বীকার করেননি। দলীয় রাজনৈতিক আশ্রয় এবং প্রশ্রয়ে আসক্তি ছিল না তাঁর।

তাঁর সমস্ত জাগতিক পুরস্কার অর্থ মূল্য তিনি নিবেদন করেছেন মানুষের জন্যে। অন্তরালে অন্তসলিলা প্রবাহের মতো তিনি বয়ে চলেছেন মানুষের হৃদয়ে কাব্যের জগতে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মাটিতে শাসক অন্তরঙ্গ বলদর্পী এক বিভীষণ, তার বিরুদ্ধে কঠিন কঠোর বিদ্রূপাত্মক উচ্চারণ করেছিল, সামগ্রিকভাবে তার প্রতিবাদ ওঠেনি। সাংস্কৃতিক জগৎ থেকে এবং রাজনৈতিক পক্ষ থেকে তারা এইধরনের অসংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন।

এক বারংবার দলবদলু ‘রাজনৈতিক’ ও ‘নেতা’ এই শব্দ দুটি তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বলেই আমি মনে করি। ৭০ দশকের যে জরুরি অবস্থা সাহিত্যকর্মের উপর যে হস্তক্ষেপ,যার মাতব্বর ছিলেন তিনি। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ আবার কে? বঙ্গ সংস্কৃতি যে আঁস্তাকুড়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এই রাজনৈতিক মাতব্বরেরা তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি।

সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে যে ব্যাপক জনবিরোধিতার ঢেউ উঠেছিল তিনি তার পক্ষে ছিলেন। তৎকালীন শাসকের রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয় পক্ষরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন, তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন হয়তো বা তাদের ভুলভ্রান্তি স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু তিনি সেই রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সহমত হন নি এবং সঙ্গ দেননি।

শাসকশ্রেণীর চরিত্র তিনি জানতেন, দল যে কি করতে পারে,কোন মানুষের লাশ যে দলের দ্বারা শনাক্তকৃত হয়, এটার সম্পূর্ণ বিপক্ষে ছিলেন তিনি। পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ তিনি শুনেছিলেন,শবের নীচে শামিয়ানায় তিনি দেখেছিলেন অসংখ্য মৃতমুখ। মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে রাজনৈতিক ঢক্কানিনাদ তিনি শুনেছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর মতোই ছিলেন। ধর্মীয় বিভেদ, দলবাজির রাজনীতির নামে দলবাজি, দুর্বৃত্তায়ন– এসবের বিরুদ্ধে প্রতি মুহূর্তে তিনি তার অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে গেছেন। ভীত হননি।

তিনি নিজে একক প্রচেষ্টায় কামদুনির সেই ধর্ষিতা মেয়েটির বিরুদ্ধে মিছিলের আয়োজন করেছিলেন সেটি একটি বাংলার রাজনৈতিক এবং সাহিত্য জীবনের স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে।

তিনি যেমন কলমে সক্রিয় ছিলেন, তেমনই আন্দোলনবিমুখ না হয়ে সেখানে অংশগ্রহণকে কর্তব্য, সামাজিক দায় এবং দায়বদ্ধতা মনে করেছেন।

কবি কতদূর যেতে পারে, কবি কতদূর যায়, তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন তাঁর কবিতা প্রবন্ধ লেখায় এবং এই ভূপৃষ্ঠে পদচারণায়।

শাসকের পদলেহনকারী দাড়িবান কবি, শিরদাঁড়া ভাঙা কবিরাও তাঁকে সময়ের জাগ্রত বিবেক বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন,তবে এটা লোকদেখানো কিনা আমার জানা নেই।