আজ দুকড়িবালা দেবীর মৃত্যুদিন। হালিশহরের অগ্নিহোত্রী বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়েছিল একদিন। ‌সেই সশস্ত্র নারী দুকড়িবালা দেবী

ফায়ার জানে, চারাগাছ ও বীজ লুকানো আছে ঝাউপাড়ায়
তমাল সাহা

কালবেলা চলে আসে আমার চোখের তারায়। প্রতিরোজ চলে আসি সান্ধ্যকালে ভাগীরথী তীরে। ওপারে চন্দননগরে লুকিয়ে ছিল বিপ্লবীরা মনে পড়ে। ডানদিকে পড়ে থাকে রামপ্রসাদ ঘাট। তারও অদূরে নটবর ঘাটে চিতা জ্বলে। বিপ্লবীরা নৌকো পেরিয়ে প্রায়শই চলে এসেছিল এপারে। এপারে রিভলবার মাস্টার বাস করে। তারকাটা বাগান– পিস্তলছোড়া,
ব্যায়ামের কসরত,লাঠিখেলার শব্দ শুনি কান পেতে প্রহরে প্রহরে। মনে পড়ে এক নারীর কথা। এখনই তো আগ্নেয় প্রহরের কথা লেখার সময় আর ভাবো ‘সাধারণ-অসাধারণ’ নারীদের কথা।
তুমি তো ভালোবাসো নারী, নারীদের মুখ। স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে তারা বাড়িয়ে তোলে অন্য এক সুখ , তারা বাড়ায় তোমার হৃদয়ে আর একটি পীড়িত রোগ, সে তো দেশপ্রেমের তীব্র অসুখ।

বীরভূম,নলহাটি গ্ৰাম। সেই ঝাউপাড়া অজ গাঁ। ব্রাহ্মণী ও তিরপাতা নদী দিয়ে জলস্রোত বয়ে যায় সেই গ্রাম ঘিরে। চাঁদ ওঠে বাঁশঝাড়ের মাথায়, জ্যোৎস্না হামলে পড়ে ঝোপঝাড়ে । গ্ৰামীণ সেই বসতি।

বিপিনবিহারী হালিশহর, কলকাতার সার্পেন্টাইন লেন হয়ে একদিন এসে পড়ে এই ঝাউপাড়ায়। কত বছর বয়স ছিল তখন তোমার, সে কি আর আমি জানি! অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলে তুমি। তখন বিপিন বিহারী তোমার গুরু আর তুমি তার শিষ্যা। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ঐতিহাসিক হয়ে ওঠো তুমি।

সেই সেই বিখ্যাত ফোর্ট উইলিয়াম ক্যান্টনমেন্ট। স্টিলের ট্রাঙ্ক ভর্তি মাউজার পিস্তল ও কার্তুজ যাচ্ছিল সেই দিকে। পথিমধ্যে লুট করে নেয় সব বিপ্লবী বারুদ বালকেরা। একটি গরুর গাড়ি ভর্তি মাউজার পিস্তল ও কার্তুজ নিয়ে গাড়োয়ান সেজে চম্পট দেয় বিপ্লবী হরিদাস দত্ত চন্দননগরের দিকে। অন্তরালে কে? কে আবার! সেই বিপিনবিহারী থাকেন হালিশহরে, যার জন্য হালিশহর এখনো গর্ব বোধ করে।

সেই লুট করা ‘মাল’ লুকিয়ে তো রাখতে হবে। চলে এলো চন্দননগরের গোন্দলপাড়ায় আগুনখোর ক্ষেত্রবাবুর ডেরায়।

বিস্তীর্ণ করো আগুন। বিস্তীর্ণ করো রণক্ষেত্র। এবার চলে এলো সাতটি মাউজার পিস্তল ও কার্তুজ ভর্তি দুটি বাক্স কোথায়?সেই সব আগুন ভর্তি বাক্সের উপযুক্ত নিরাপত্তা চাই। অগ্নিহোত্রীরা কোনোদিন পৌঁছে দিয়েছিল তোমার এই সুদূর পাড়াগাঁয়ে। তোমার বাড়ি ছাড়া আর এই মূল্যবান গহনা সম্পদ কোথায় রাখা যায়?

একই দেশে বিশ্বাসী সাহসীরা থাকে। আবার ঘুরে বেড়ায় খোচর বিশ্বাসঘাতকের দল। নাহলে যুদ্ধের আসর জমাটি হবে কেন? সংগ্রাম তো এই কারণেই রহস্য-রোমাঞ্চকর উত্তেজক ও রোমহর্ষক হয়ে ওঠে!

তারপর সেই ঘনায়মান রাত। ৭ জানুয়ারি,১৯১৭। একটি সূত্রে গোয়েন্দারা জেনে যায় কোথায় লুকানো আছে সেই ‘গাছের চারা ও বীজ’। চলে জোর খোঁজ ও খানা তল্লাশি। ঘ্রাণ ও শ্রবণশক্তি তীব্র ছিল তোমার। তুমি তো আত্মনিবেদিত নারী। অন্ধ রাতে বিনিদ্র জেগে থাকো, নিদ্রাহীন পাহারায়।

ডালকুত্তারা আসে তোমার ডেরায়। মনে পড়ে সেই সিআইডি ইন্সপেক্টর সুবোধ চক্রবর্তী। খুঁজে বেড়ায়। তুমি তার চেয়েও বেশি সাহসী। বিছানা! মাথার বালিশের নিচ থেকে বার করে নিলে সেই ‘অগ্নিবান ছানা’। কোমরে গুঁজলে আরো একটি। কাজের লোক পাঁচকড়ি লেট।তার মাথায় করে সেই অস্ত্রের বাক্স নিজের বাড়ি থেকে খালাস করে দিলে‌, পৌঁছে দিয়েছিল পাঁচকড়ি পড়শি সুরধনী মল্লানীর বাড়ি। তুমি আগে যেন সশস্ত্র কনভয়। পিছে অস্ত্রবাহক।
আগে চলে নারী দুকড়ি, পিছে পুরুষ পাঁচকড়ি!
লক্ষ্য স্থির ছিল তোমার, সঠিক চাঁদমারি।
গুরু তো তোমার আমাদের হালিশহরের বিপ্লবী বিপিন বিহারী।

শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসঘাতক দেখিয়ে দিল ওই বাড়ি। সুরধনীকে নিয়ে ধরা পড়ে গেলে তুমি। ভারতের মুক্তি সংগ্ৰামে তুমি অস্ত্রদণ্ডে দণ্ডিতা প্রথম নারী।
জানি সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল তোমার। প্রতিদিন ডাল ভাঙতে হতো আধ মণ। ভুলি কি করে এইসব বীরাঙ্গনা নারী!

মাসিমা! মাসিমা! তুমি বিপ্লবীদের মাসিমা। নও তো বুড়ি,তুমি দুকড়ি।
ক কড়ি দিয়ে তোমাকে কেনা যায়,
দুর্লভ দুর্মূল্য সেই কড়ি।
আজো তুমি আমাদের পাশে আছো,হে বিপ্লবের অতন্দ্র প্রহরী।

অগ্নিকন্যা জন্মেছিলেন ২১ জুলাই,১৮৮৭। চলে গিয়েছেন ২৮ এপ্রিল,১৯৭০।