অবতক খবর,৫ এপ্রিলঃ রটে গেল গ্রামে গ্রামে সার্কাসের তাঁবু পড়েছে রথতলার ময়দানে কল্যাণীতে।

কৃষ্ণচন্দ্র রাজার রাধাকৃষ্ণজিউ মন্দির সংলগ্ন মাঠে। হই হই ব্যাপার রই রই কান্ড–আফ্রিকার খেলোয়াড় নিয়ে ডায়মন্ড সার্কাস। পোস্টার পড়েছে শহরেগঞ্জে।

সার্কাস আছে অথচ বাঙালি নেই এমন হতে পারে! এখন দ্বাদশ শ্রেণীতে মানে উচ্চমাধ্যমিকে বাংলা সাহিত্যে ‘সার্কাসে বাঙালি’ এই বিষয়টি সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত।

কাঁচরাপাড়া সঙ্গে ক্যাচড়া শব্দটি যুক্ত থাকলেও এর প্রতি আমার একটি অনুরাগ আছে। বিজপুর থানা প্রশাসন সংলগ্ন আমাদের সার্কাস ময়দান প্রায় দুই শতাব্দি প্রাচীন— এটি একটি রেল মাঠ। শীতে নিয়মিত সার্কাস হত বলেই শেষ পর্যন্ত এই মাঠটির নাম হয়ে যায় সার্কাস ময়দান। এই মাঠের দক্ষিণ দিকের এক কোণায় যেখানে সার্কাস ময়দান অ্যাসোসিয়েশন ক্লাবটি হয়েছে, আগে সেখানে ছিল রেলের সোয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট।

এখানে জেমিনি সার্কাস, ইন্টারন্যাশনাল সার্কাস,এশিয়ান সার্কাস, অলিম্পিক সার্কাস তাঁবু ফেলেছে যাকে সার্কাসের পরিভাষায় বলে টপ টেন্ট।

সার্কাস ময়দানের সার্কাস মানেই সন্ধ্যে হলে সার্চলাইটের লাইটের তীব্র আলোর প্রক্ষেপণ, দিনে সিংহের গর্জন। মা বলতো, সার্কাস ময়দানে সার্কাস আইছেরে তমু! আমরা তখন ফাইভ সিক্সে পড়ি। দিনের বেলায় সার্কাসের মাঠে চলে যেতুম আর করোগেটেড টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাঘের খাঁচা, সিংহের খাঁচা, ঘোড়া, ভালুক এসব দেখতুম। আর দেখতুম সার্কাস রমণীদের। সার্কাস রমণীরা তাদের লিভিং টেন্টে নিজেরা রান্না বান্না করছে, এসব দৃশ্যও চোখে পড়তো।

বাঙালির সার্কাস, সার্কাসে বাঙালি। ছোট জাগুলিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা। প্রিয়নাথ বসু। সেটা ১৮৮৭ সাল। তৈরি করে ফেললেন সার্কাসের দল। ছিলেন ব্যায়ামের আখড়ার প্রশিক্ষক হয়ে গেলেন সার্কাসের মালিক। সার্কাস দেখাবে শুধু সাদা চামড়ার লোক, মালিকও হবে সাদা চামড়ার সাহেব সুবো! এ আবার হয় নাকি?

অনেক কষ্টে টাকা পয়সা জোগাড় করে কিনে ফেললেন তাঁবু, জোগাড় করলেন কয়েকজন জিমন্যাস্ট- খেলোয়াড়। তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করে দিলেন, আমার দলে কোন বিদেশী খেলোয়াড়ের অনুপ্রবেশ নেই। সব খেলোয়াড়ই হবে দেশী, সাদা চামড়াকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আমি গড়তে চাই নেটিভ সার্কাসের দল। খুলে ফেললেন সার্কাসের পার্টি– নাম প্রফেসর বোসেস গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস। সার্কাসের মালিক সে আবার প্রফেসর কেন? বড়লাট ডাফরিন জিমন্যাস্টদের খেলা দেখে তো মুগ্ধ! জানতে চাইলেন, হু ইজ দা প্রফেসর? সেই থেকে প্রিয়নাথের নামের আগে বসে গেল প্রফেসর শব্দটি।

১৮৯৬ সাল এই সার্কাস প্রদর্শিত হলো গোয়ালিয়রের রাজার জয়বিলাসৎপ্যালেসে। রাজা বাবাজি মহা খুশি। প্রিয়নাথকে দুটি বাঘ উপহার দিলেন। বাঘ দুটির নামকরণ হলো লক্ষ্মী ও নারায়ণ। বাংলায় এই প্রথম সার্কাসের শুরু হয়ে গেল বাঘের খেলা।

সার্কাস থাকবে আর রমণীয় নারীরা থাকবে না তাই কি হয়? সুশীলাসুন্দরী ও কুমুদিনী দুই বোন ভেঙে ফেললেন সামাজিক প্রথা। সামাজিক কুৎসা ও জীবনের ঝুঁকি সম্বল করে নেমে পড়লেন সার্কাসের ময়দানে। সুশীলাসুন্দরী খালি হাতে ঢুকে পড়তেন বাঘের খাঁচায়, বাঘের খেলা দেখাতেন আর চরম উত্তেজনা মুহূর্তে বাঘকে জড়িয়ে গালে চুমু খেতেন তিনি। কবরে যাবার খেলাও তিনি দেখাতেন।

মাটিতে গর্ত করে সমাধিস্থ হবার পর সমাধিস্থলটি কাঠের পাটাতন দিয়ে ঢেকে দেওয়া হতো। তার ওপর ঘোড়ার খেলা প্রদর্শিত হতো। ঘোড়ার খেলার শেষে পাটাতন হটিয়ে মাটি ভেদ করে উঠে আসতেন সুশীলাসুন্দরী। ইনি এবং তার সহোদরা কুমুদিনী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাপিজের কলাকৌশল দেখাতেন। আর মৃন্ময়ী দেবী? হাতির পিঠে হাওদায় বসে বাঘের খেলা দেখাতেন।

সেই সময়ে  নারীরা সামাজিক অনুশাসন বিধি ভেঙে সার্কাসে শিল্প-কর্ম দেখাচ্ছেন ভাবা যায়?

সেই বিখ্যাত জাদুকর গণপতি চক্রবর্তী তার বিখ্যাত খেলা ইল্যুসন বক্স- এর খেলা দেখা দেখাতেন। তাকে বস্তায় পুরে দড়ি দিয়ে জবরদস্ত করে বেঁধে বাক্সে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। এরপর বাক্সটি তালা বন্ধ করে তার ওপরে রেখে দেওয়া হতো তবলা এবং একটি ঘন্টা। তারপর পর্দা দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো। দর্শকদের কেউ তালের উল্লেখ করলে তবলায় সেই তাল বেজে উঠতো পর্দার ভেতর থেকে। শেষ মুহূর্তে পর্দা সরিয়ে ঘন্টা বাজাতে বাজাতে উঠে আসতেন গণপতি। ব্যায়ামবীর ভবেন্দ্রনাথ সাহার বুকের উপর পাতা থাকত কাঠের পাটাতন। সেই পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যেত বিশালকায় হাতি। রিং মাস্টার মন্মথনাথ দে চোখবাঁধা অবস্থায় দ্রুততার সঙ্গে উঠে পড়তেন ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে। আর প্রখ্যাত কুস্তিগীর বাদলচাঁদ তো অতুলনীয় অবিস্মরণীয়! তিনি বাঘের সঙ্গে রীতিমতো কুস্তি লড়তেন। আর সেই চরম মুহূর্ত! দুহাতে বাঘের চোয়াল উপর নিচে ঠেলে বিশাল হাঁ-মুখ সৃষ্টি করতেন। তারপর সেই হাঁ-মুখে ঢুকিয়ে দিতেন নিজের মাথা। এই না হলে সার্কাস!এই না হলে বাঙালির বাচ্চা, দুনিয়ার সাচ্চা!

আর প্রিয়নাথ? স্বদেশ চেতনা ও সার্কাসকে মিশিয়ে দিয়ে অন্য একমাত্রা এনে দিয়েছিলেন সার্কাস শিল্পে। সার্কাসের যবনিকা পতনের আগে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য দেশবাসীর প্রতি তার মন্দ্রকণ্ঠের ভাষণ ও আহ্বানে দর্শকেরা যুগপৎ উদ্বেলিত ও উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। বন্দেমাতরম! সম্মিলিত দর্শকের সমস্বরের প্রাণময় ধ্বনিতে উত্তাল ও উষ্ণ হয়ে উঠতো শীতের বাতাস।