পর্ব-১ স্বাধীনতার ৭৫ বছর ও আমি

অর্ধসত্য কত ভয়ঙ্কর!
তমাল সাহা

স্বাধীনতা প্রাপ্তি কি চৌর্যবৃত্তি? তবে মধ্যরাতে কেন দেশকে খণ্ড করে ক্ষমতার ভোগ সর্বস্ব দখল হয়? স্বাধীনতা কি সুদৃশ্য নারী! রাতে সবাই যখন ঘুমে আচ্ছন্ন তখন তাকে ধর্ষণ করাত চালিয়ে শরীরটা দুফালা করতে হয়! এক টুকরো কত সহজেই হিন্দুস্তান হয়ে ভোগবাদী পণ্য হয়ে পড়ে আরেক টুকরো হয়ে যায় পাকিস্তান উপভোগ্য সম্ভার। স্বাধীনতা মানে কি ক্ষমতায়ন? অন্যদিকে মানবিক বিপন্নতা! অত গভীর রাতে মানুষ নিদ্রামগ্ন, ঘুমকাতুরে চোখে স্বাধীনতা শব্দ উচ্চারণ শুনে মানুষেরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। কি করবে তারা এখন? স্বাধীনতা মানে পালাও! দেশ ছেড়ে ভাগো!

স্বাধীনতার রাতেই শুরু হয় পলায়ন পর্ব। মানুষ বিপন্ন,ধর্মীয় জুজু সেই থেকে মহাভারতীয় এই বাতাসে– তার কোনো এপার ওপার নেই। মুখ থুবড়ে পড়া মানুষ, আশাহত মানুষ নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। চাঁদকে দেখতে দেখতে চোখের জল ঝরে এক ঘনায়মান অন্ধকারের ভেতর।
মা বাবা ভাই বোন কিছু বাক্স প্যাটরা গাঁটরি নিয়ে পালানো যায়? কিন্তু অত বড় জন্মভূমি, তার জল বাতাস গায়ে মাখা এই শরীর সেই জন্মভূমি মাকে কাঁধে করে বুড়ি ষগঙ্গার তীর পেরিয়ে গোয়ালন্দগামী
ট্রেন হয়ে দর্শনা পেরিয়ে রানাঘাটে এনে পৌঁছানো যায়? হায়! দেশজ মাকে রেখে সন্তান পালায়। মা সেই দৃশ্য দেখে আর বুকফাটা আর্তনাদে কেঁদেই চলে।

পড়ে থাকে মায়ের হাতে নিকোনো বিশাল উঠোন। সেই উঠোনে মায়ের হাতেই মাটি ঠুসে ঠুসে বানানো তিন ঝিকের উনুন, উঠোনের আর একটু দূরে পড়ে থাকে কাঠের গুড়ি, বাবার হাতের কুড়ুলখানি—কাঠের চেরার যন্ত্র। আর ওপাশে উঠুনে দাঁড়িয়ে থাকে ঝাপড়া পেয়ারা গাছটি। পড়ে থাকে তুলসী মঞ্চ- জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাওয়া সলতে পোড়া পিদিমখানি।
নিজের বসত ছেড়ে একটু দূরে পীর বাবার মাজারের বুকে জ্বলে যায় চিরাগ।

তুমি এখন বাস্তুভিটেহারা উদ্বাস্তু। এবার তুমি হবে রিফিউজি, শরণার্থী— তোমার মাথার উপরে কোনদিন চালা ছিল, একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল। তাও এখন নেই। ‌কারণ তুমি স্বাধীনতা পেয়েছো। স্বাধীনতা মানে তো ঠাঁই নড়ে যাওয়া।জীবন তো তখন থেকেই খুঁজে ফেরি। ‌ জীবন মানে বিচ্ছেদ বিষাদ আর লড়াই। ভুলে যাই আসগর চাচার ডাক, মোসলেম আলীর মুখ, নিশাতের চাউনি। চারিদিকে শূন্যতা জড়ানো ভয়।

তেলেঙ্গানার হাজার হাজার মাটির মানুষের জীবনঋদ্ধ স্লোগান সোচ্চার হয়ে উঠেছিল সেদিন। —- ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়।
লাল পার্টি কমিউনিস্টরা এই শোরে ধূমায়িত করে তুলেছিল আকাশ বাতাস। এটা কি ভুল ছিল? বিরোধীরা কৌশলী সুযোগ পেয়ে গেল। এতো রক্তপাত, বলিদানের কথা কমিউনিস্টরা জানে না? এতো ফাঁসির মঞ্চ, এতো শহীদ, এদিকে জালালাবাদ পাহাড়, ওই দিকে বুড়িবালামের তীর, রাইটার্স বিল্ডিং-এর অলিন্দ যুদ্ধ! এতো সবের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা! এই মুক্তি এলো!আর এরা বলে কিনা এ আজাদী ঝুটা হ্যায়!

সত্যিই কি তাই? কমিউনিস্টরা তো একথা বলেনি, স্লোগানটি তো এমন ছিল না। নিজের মতো করে সুযোগসন্ধানীরা ব্যবহার করে ৮টি শব্দের স্লোগানকে চারটি শব্দবন্ধে রূপান্তর করলো কার স্বার্থে, কোন উদ্দেশ্যে এই অপ্রচার, গোয়েবলসীয় প্রচার? একে বলে অপরাজনীতির কলা ও কৌশল।

স্লোগানটি ছিল, ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়,লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়। কারা? স্বাধীনতার প্রথম পর্বেই আবার মিথ্যার বেসাতি শুরু করলো! কি করে ‘লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’এই চারটি শব্দবন্ধ, কি কারণে স্বাধীনতার মুহূর্তেই কারা গায়েব করে দিল? একটা সাচ্চা মজবুত স্লোগান ছিল, তার জন্ম হয়েছিল স্বাধীনতার জন্মলগ্নে! তারপর তার কি করে অকাল মৃত্যু ঘটলো, হয়ে গেল হাপিজ!!