অবতক- এর বিশেষ প্রতিবেদন : রাস্তার নাম পরিবর্তন, শহিদ অশোক মিত্র, না সমাজসেবী মৃণাল সিংহরায়, কে অপমানিত হলেন?

ছাত্র শহিদের নামে রাস্তার নাম পাল্টে দিল পৌরসভাঃ জাতীয় যুব দিবসে কাঁচরাপাড়ায় কলঙ্কজনক ইতিহাস!

তমাল সাহা,অবতক খবর, ১৩ জানুয়ারিঃ বঙ্গ সংস্কৃতির রুচিতে ধ্বস নেমে এলে খন্ডহর হতে থাকে শাসকের বিবেক, বুদ্ধি, চেতনা। সাংস্কৃতিক বিপর্যয় চলছে এই গাঙ্গেয় উপত্যকায়। ভাগীরথীর উপকূলে এই কাঁচরাপাড়াও আজ এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করলো।

আজ একটি বিশেষ দিন। জাতীয় যুব দিবস। স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৮ তম জন্মদিবস। পৌষ সংক্রান্তির এই সময়ে এক ছাত্র শহিদকে অপমান করা হলো তার নাম অশোক মিত্র। কাঁচরাপাড়ার জনপদে যে স্থলে তিনি রক্তস্নাত হয়েছিলেন কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা এবং নিহত হয়েছিলেন সেই ধোবিপুকুর রোডের রাস্তাটি তাঁর নামে উৎসর্গ করা হয়েছিল অশোক মিত্র রোড হিসাবে। অশোক মিত্র ছিলেন শিক্ষক আন্দোলনের ছাত্র শহিদ। ভারতের ইতিহাসে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। শিক্ষক আন্দোলনে তাদের ন্যায্য দাবী পূরণে সক্রিয় সহযোগী হয়েছিল ছাত্র যুবকেরা।

সেদিন ছিল ৩ এপ্রিল, ১৯৬৮। তখন কংগ্রেসী জমানা। আর. পি. হাই স্কুলে চলছিল স্বৈরাচারতন্ত্র। লাল রঙে ছুপানো কিছু মাস্টারের শিক্ষকতা বাতিল করা হলো। তাদের পুনর্নিয়োগের দাবিতে শিক্ষক ছাত্রদের যৌথ মিছিল ধোবিপুকুর রোডে অবস্থিত স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সম্পাদকের বাড়িতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল। সেই দীর্ঘ বিক্ষোভ অবস্থানেই সিদ্ধান্ত হলো দাবি না মেটা পর্যন্ত এখানেই অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থান চলবে। বিক্ষোভ ছিল শান্তিপূর্ণ। বিক্ষোভ চলাকালীন ম্যানেজিং কমিটির সম্পাদকের দোতলা বাড়ির ছাদের ওপর থেকে ছোঁষড়া হতে থাকে পাথর, ইট, বাল্ব, বোতল। বিক্ষোভ চরমে ওঠে। বিক্ষোভ প্রতিরোধে পুলিশ আসে। টিয়ার গ্যাসের শেল ফাটানো হয়। ইতিমধ্যে কোনো কৌশলী হাতের নৈপুণ্যে নিভে যায় সড়কের আলো। সেইসময় একটি বিশাল বড় পাথর খন্ড আছড়ে পড়ে অশোক মিত্রর মাথার উপর। মাথা ফাটিয়ে ঘিলু বেরিয়ে পড়ে। তারপর রেল হাসপাতাল এবং তারপর কলকাতার নীলরতন সরকার হাসপাতালে স্থানান্তর। ৪ এপ্রিল মারা যান অশোক মিত্র। শিক্ষক আন্দোলনের প্রথম ছাত্র শহিদ তিনি।

একজন শহিদের নামে রাস্তার নামকরণ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে এক সর্বজনপ্রিয় সমাজসেবী ব্যক্তিত্বের নামে নামকরণ হলেও সেটা কোন শিষ্টাচার ও মর্যাদার পরিচায়ক তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। এটি সম্ভবত বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণযোগ্য কলঙ্কিত ঘটনা হয়ে থাকবে।

আজ এই রাস্তাটির নামকরণ করা হয় মৃণাল কান্তি সরণি, (আবুদা)। বেকারত্ব দূরীকরণে আবুদার ছত্রিশ’শ প্যানেল আজ ইতিহাস। খরা, বন্যাত্রাণে, দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় তাঁর ভূমিকা তুলনাহীন। আবুদার নাম একসময় হয়ে গিয়েছিল ‘বেকারদের ভগবান’। তাঁকে স্মরণযোগ্য করে রাখতে তাঁর নামে রাস্তার নামকরণ নিশ্চিতভাবে কাম্য এবং উচিত। কিন্তু একজন শহিদেকে অবমাননা করে সেই রাস্তার নাম আবুদার নামকরণে পরিণত করাতে কে লজ্জিত হলো? কে অপমানিত হল? শহিদ অশোক মিত্র, না কি সমাজসেবী মৃণাল সিংহরায় ? আবুদা জীবিত আছেন এমন কালে এমন কোনো ঘটনা ঘটলে তিনি নিশ্চিত এর প্রতিবাদ করতেন। তাঁর চরিত্র এমনই ছিল।

আরও প্রশ্ন, নতুন কোনো রাস্তার নামকরণ তাঁর নামে করা হল না কেন? যে রাস্তা ইতিমধ্যেই সরকারি ভাবে ভোটার লিস্টে মানুষের বাড়ির ঠিকানায় স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছে সেই স্থলে এখন লিখতে হবে মৃণাল কান্তি সরণি। স্বাভাবিক ভাবেই নতুন রাস্তাটি চিনতে নাগরিকদের অসুবিধে হলে বলতে হবে অশোক মিত্র রোডই মৃণাল কান্তি সরণি নামে রূপান্তরিত হয়েছে। তাতে কি আবুদার সম্মান বাড়বে? এই নামকরণের বোঝা আবুদাকে বয়েই যেতে হবে। তাঁর আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকেও এভাবে ‘লোকদেখানো ছেলেভোলানো’ নামকরণের প্রতিবাদ হলো না কেন, তাও বোঝা গেল না।

অনেক রাস্তা আছে যার নামকরণ নেই তা নিশ্চিত মৃণাল কান্তি সরণি হতে পারতো, পৌর প্রশাসনিক ব্যবস্থার যথাযোগ্য উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায়। কোন্ কোন্ রাস্তা হতে পারতো কিন্তু তানা করে এই পদক্ষেপ নেয়া হল কেন সেটাই বড় প্রশ্ন।

আরও উল্লেখযোগ্য নামকরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মৃণাল সিংহরায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকলেও তাঁর জীবনের শেষবেলায় তাঁর সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ ছিল না এবং অসুস্থ কালে তৃণমূল দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব হিসাবে তাঁকে দেখভালের দায়িত্ব তাদের নিশ্চিত ভাবে ছিল। ২০১১ র নির্বাচনে সকলেই জানতেন মৃণাল সিংহরায় নিশ্চিত ভাবে তৃণমূল দল থেকে বিধানসভার প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন পাবেন কিন্তু তাঁকে বঞ্চিত করা হয়। সে সময়ে এই সমস্ত উচ্চ স্তরের তৃণমূল নেতৃত্ব, কর্মী সদস্যরা এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ জানাননি। হঠাৎ মৃণাল সিংহরায়ের প্রতি তাঁরা এত আবেগমথিত হয়ে পড়লেন কি কারণে এটা সাধারণ মানুষের কাছে রহস্যময়।

এই সরণির উদ্বোধনে জড়িয়ে পড়লেন এক সময়ের শ্রেষ্ঠ সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদী এবং সাংস্কৃতিক কর্মী হিসাবে পরিচিত নৈহাটী বিধায়ক পার্থ ভৌমিক।

কোনো রাস্তার নাম পরিবর্তনের তিনটি পর্যায় আছে। ১) পৌর সিদ্ধান্ত, ২) পাব্লিক নোটিফিকেশন যাতে নাগরিকদের মতামত দেবার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা ধার্য করা থাকে  ও ৩) জেলা শাসকের অনুমোদন। এই তিনটি স্টেজ এর পরেই সাধারণতঃ কোনো রাস্তার উদ্বোধন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।

প্রথমটা নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের পক্ষে অভিযোগ জানিয়ে বলা হয়েছে যে এই মুহূর্তে কোনো নির্বাচিত পৌর বোর্ড নেই। প্রশাসক দায়িত্বে রয়েছেন। তাই রাস্তায় নামকরণ নিয়ে পৌর বোর্ডের সিদ্ধান্তের প্রশ্নই উঠেনা।  বলা যেতেই পারে যে এটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে সিদ্ধান্ত হয়নি। তাছাড়া জানা গেছে এ ক্ষেত্রে দু নম্বর এবং তিন নম্বর পর্যায়ের প্রক্রিয়া বাদেই রাস্তাটির উদ্বোধন হয়ে গেছে অর্থাৎ স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে এই রাস্তাটির নাম পরিবর্তন করা হয়েছে।

বিশ্বের ইতিহাসে শহিদের নাম পরিবর্তন করে রাস্তার অন্য নামকরণ করে কাঁচরাপাড়া পৌরসভা সেই কলঙ্কময় ইতিহাস সৃষ্টির নজির স্থাপন করলো। আর আগামী দিনেযে আবার এই রাস্তার নাম ক্ষমতার জোরে অন্য কোনো পৌর বোর্ড ক্ষমতায় আসে পাল্টে দেবেনা এটাও জোর দিয়ে কেও বলতে পারবেননা।