অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদন : অঝোর বৃষ্টিতে কাঁচরপাড়ায় ভাষণ দিলেন সাংসদ জ্যোতির্ময় বসু

অবতক খবর : আজ ১৮ ডিসেম্বর’১৯। জন্ম শতবর্ষে পা রাখলেন দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান জ্যোতির্ময় বসু। শাসক সরকারি দলকে নাস্তানাবুদ ও নাজেহাল করে ছাড়তেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রীতিমতো ভয় করতেন তাঁর যুক্তিগ্রাহ্য বাচন শৈলীকে। তিনি কাঁচরাপাড়া সার্কাস ময়দানে বক্তব্য রাখেন।সেটা ১৯৭৭ সাল। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

বৃষ্টির মধ্যে বক্তৃতা

বৃষ্টির মধ্যে গান কবিতা হয়
অঝোরে বৃষ্টির মধ্যে বক্তৃতাও হয়
শত শত মানুষ বৃষ্টিতে ভিজে সেই বক্তৃতা শোনে
বৃষ্টিকে হারিয়ে দেয় বক্তার যুক্তির ধারাভাষ্য এবং শ্রোতাদের মনোযোগ।

এমন একটি যুগান্তকারী ঘটনার অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা কাঁচরাপাড়ার বুকে তৈরি করে গেছেন একজন দক্ষ দাপুটে বক্তা। তিনি ছিলেন ভারতীয় পার্লামেন্টের একজন উল্লেখযোগ্য সাংসদ।

১৯৮০ সালে তিনি যখন সাংসদ হয়ে জিতে ফিরে আসেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর মুখোমুখি দেখা। ২৬ জুন ১৯৭৫ মধ্যরাতে জরুরি অবস্থা জারি করে কুখ্যাত হয়েছিলেন একদা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তবে ১৯৮০-তে তিনি তাঁর মসনদ পুনরুদ্ধার করেন। সে সময় সংসদ চত্বরে
এই সাংসদের সঙ্গে সাক্ষাত হতেই ইন্দিরা গান্ধী বলে ওঠেন, এই রে! এবার আবার আপনার প্রশ্নবাণের মোকাবিলা করতে হবে আমাকে।

কে এই সাংসদ? জ্যোতির্ময় বসু। শানিত যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা ও হাতে প্রমাণের নথিপত্র মানেই জ্যোতির্ময় বসু৷ জ্যোতির্ময় বসু মানেই আবিষ্কার ও অনুসন্ধানের নথিপত্র।

 

১৯৬৭ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ।
সেটা ১৯৭৪-৭৫ সাল।সে সময় দেশ জুড়ে তোলপাড় মারুতি কেলেঙ্কারি। এই কেলেঙ্কারির নায়ক ইন্দিরা গান্ধীর কনিষ্ঠ তনয় সঞ্জয় গান্ধী।

কীভাবে সেই গাড়ি নির্মাণের দায়িত্ব অন্যায়ভাবে দেওয়া হয় স্বজনপোষণের মাধ্যমে সঞ্জয় গান্ধীকে তা জ্যোতির্ময় বসু তুলে ধরতে থাকেন কাঁচরাপাড়া সার্কাস ময়দানে সিপিআইএম আয়োজিত এক জনসভায়। একটির পর একটি তথ্য তিনি তুলে ধরতে থাকেন এবং জনসাধারণের মধ্যে কৌতূহল বাড়তে থাকে।
তাঁর বক্তব্য পেশের বাক বৈদগ্ধ্য শ্রোতাদের আবিষ্ট করে ফেলে।

এদিকে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। সে এক ধূম বৃষ্টি! তিনি বক্তৃতা থামিয়ে দিতে যান কিন্তু উৎসুক জনতার সোল্লাস চিৎকার, ‘আপনি বলুন, আপনি বলতে থাকুন। আমরা বৃষ্টিতে ভিজেই শুনবো’। জনতার চরম আকাঙ্ক্ষা শেষ পর্যন্ত তিনি নিবৃত্ত করতে পারেন না। তাঁর মাথায় ছাতা ধরা হয়। তিনি একের পর এক যুক্তি দিয়ে মারুতি কেলেঙ্কারির কথা বলতে থাকেন। শ্রোতাদের যাদের ছাতা ছিল না তারা অন্যের ছাতার তলায় কমপক্ষে তিন চারজন মাথা ঢুকিয়ে তাঁর বক্তৃতা শুনতে থাকেন।

সরকার জনগণের জন্য ছোট গাড়ি তৈরি করবেন। সেই প্রকল্পের দায়ভার পান সঞ্জয় গান্ধী। সঞ্জয় গান্ধী লগ্নিকারীদের ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলিং করতে থাকেন। প্রশ্ন ওঠে মারুতি সংস্থাকে কেন দেওয়া হবে এই প্রকল্পের দায়িত্ব। সঞ্জয় গান্ধীর গাড়ির অভিজ্ঞতা কী? গাড়ির কোনো নক্সা না থাকা সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রীসভা তাকে অনুমোদন দেয়। প্রশ্ন ওঠে এই গাড়ি কি বিশুদ্ধ ভারতীয় গাড়ি হবে ?

একচেটিয়া ভাবে এই কোম্পানিকে বছরে পঞ্চাশ হাজার গাড়িকে অনুমোদন দেওয়া হয়। তখন হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী বংশীলাল ইন্দিরা গান্ধীর অত্যন্ত কাছের মানুষ। তাঁকে দিয়ে কৃষকদের জমি কম দামে কিনে সঞ্জয় গান্ধীর মারুতি লিমিটেড উদ্যোগের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয় এবং গুরগাঁওয়ের খামার্ এলাকা ও ওই অঞ্চলের যে সামরিক গোলাবারুদের গুদাম ছিল তা সরিয়ে দেওয়া হয়।

মারুতি গাড়ি পথে চালানোর উপযুক্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলেও ১৯৭৪ সালে পঞ্চাশ হাজার গাড়ির অনুমোদন দেয় ইন্দিরা গান্ধীর সরকার। ১৯৭৫ সালের ২৬ জুন জরুরি অবস্থা জারি হলে সঞ্জয় গান্ধী সর্বেসর্বা তো বটেই আরও মারাত্মক হয়ে ওঠেন। জনপথের ব্যবসায়ীদের হুমকি দেওয়া হয় তারা মারুতির শেয়ার না কিনলে তাদের দোকানপাট গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। সিংহানিয়াদের এক এক্সিকিউটিভকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তার পরিবারের থেকে শেয়ার কেনা হলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

গাড়ি উৎপাদন না হওয়ায় এক লগ্নিকারী টাকা ফেরত চাইলে তাকে মিসায় গ্রেপ্তার করে দুমাস জেলে আটকে রাখা হয়।

ক্ষতিতে চলায় সঞ্জয় গান্ধী আরেকটি সংস্থা মারুতি টেকনিক্যাল সার্ভিসেস চালু করেন এবং সেখান থেকে মোটা অঙ্কের বেতনের টাকা নিতে থাকেন। পরে আবার তৃতীয় সংস্থা হেভি ভেহিক্যালস চালু করেন।

১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর চরম পরাজয় ঘটে। সেই সময় মোরারজি দেশাইয়ের শাসন কালে বিচারপতি এ পি গুপ্তার নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গাড়ি প্রকল্পের গোটা অধ্যায় সম্পর্কে নেতিবাচক রিপোর্ট দেন।

জ্যোতির্ময় বসু তাঁর বাগ্মিতার দক্ষতায় একের পর এক ঘটনা জনসাধারণ কাছে তুলে ধরেন।
রাষ্ট্রের এই কেলেঙ্কারি বৃষ্টিতে ভিজে একসা হয়েও জনতা অত্যন্ত মনোগ্রাহী হয়ে শুনতে থাকেন।

মানুষের রাজনৈতিক চেতনাকে ঋদ্ধ করবার জন্য তাঁর সেই স্মরণীয় বক্তৃতা আর সেই বৃষ্টির দিনটি আজও কাঁচরাপাড়ার বুকে একটি ইতিহাস হয়ে আছে।

উল্লেখ্য, ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ এই দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ানের জন্মের শতবর্ষ।