অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদনঃ

১৭ নম্বর এজলাস
তমাল সাহা

কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি ক্রমাগত ঘন হতে থাকে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে হয়তো বা ক্ষীণ সরলরৈখিক একটি আলোকরশ্মি তীব্র বেগে ছুটে আসে। আলোর গতিবেগের রেঞ্জ তো এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল প্রতি সেকেন্ড। জেগে ওঠে ভাগীরথী উপকূলের বিস্তৃত চত্বর। ক্ষুদিরামের চেতাবনি বুক, অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে সূর্যসেনের বিশাল পূর্ণ অবয়ব। ন্যায়ালয়ের সমস্ত রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে জেগে ওঠে ব্যবহারজীবীদের পৈশাচিক হট্টগোল। তারা নিজেরাই ঘিরে ফেলে বিচারকের এজলাস। মানবতাকে প্রাধান্য দিয়ে নির্দেশনামা জারি করে যে ন্যায়াধীশ তাঁকে আমরা মানি না। এমন স্লোগানে বিস্তীর্ণ হয়ে ওঠে আদালতের বিস্তৃত চত্বর। তখন গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলি এক এক করে ভাঙতে থাকে। শাসকের প্রতিভূ এইসব চাটুকার আইনজীবীদের মুখোশ খসে যায়।

প্রত্যয়ের চেয়ে বড় কিছু নেই। তুমি জানো শরীরের মৃত্যু হয়। চেতনার মৃত্যু নেই। বিচারালয়ের বাইরে সারবান বৃক্ষরাজির পত্রসমূহ আন্দোলিত করে একটি কণ্ঠ বেরিয়ে আসে এজলাসের কুঠুরি হতে– মাথায় বন্দুক ধরতে পারেন। মারতে পারেন, মরতে রাজি। কিন্তু কোনো দুর্নীতি দেখে কখনো চুপ করে থাকব না। আওয়াজ তুলবোই।

আদালতের আগে কেন মহামান্য বসে? বিচারককে কেন ন্যায়াদীশ বলে? কেন তাঁর বিচারের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা, সেটা তুমি ক্রমাগত শিখিয়ে চলো। সবই কি বাজারে বিক্রি হয়? সব চেতনাই কি বিকৃত হয়? এর জবাবের দায়বোধ ও কর্তব্যের মহিমা নিয়ে যখন হয় কেউ মাথাউঁচু করে দাঁড়ায়,তখন তার মধ্যে একক শক্তি বিশাল হয়ে ওঠে। অসহায় মানুষ, বিপন্ন বিপর্যস্ত মানুষ এইসব দৃশ্য দেখে আর তার বুকে হতচকিতে দেবদারু গাছের বাতাস ঢুকে পড়ে।

ন্যায়াধীশ কি করতে পারে? ক্রমাগত দেখাও তুমি। রায়গঞ্জ করোনেশন স্কুলের শিক্ষিকার পাশে দাঁড়াও।

বীরভূমের নলহাটির কর্কট আক্রান্ত লড়াকু সোমা দাসকে বিকল্প চাকরির নির্দেশ দাও। কিন্তু তোমার নির্দেশকে সাবাস জানিয়ে সেই না-চাকরি পাওয়া লড়াকু নারীটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝড় জল বৃষ্টির মধ্যে একক উন্নয়ন চায় না,চায় সহযোদ্ধা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিশে যেতে।

সে এক দৃশ্য! ৭৬ বছরের বৃদ্ধা শিক্ষিকা শ্যামলী ঘোষকে মনে পড়ে। এজলাসেই জয়ের আনন্দে কেঁদে ফেলে। তোমাকে আশীর্বাদ করে। ২৫ বছরের বকেয়া বেতন তুমি ফিরিয়ে দিয়েছো মাতৃসমাকে।

ক্যান্সারাক্রান্ত শিক্ষিকার ১২ দিনের রুজি কেড়ে নিলে, প্রধান শিক্ষকের পদ কেড়ে নাও তুমি। প্রধান শিক্ষককে জানিয়ে দাও, স্কুলে ঢোকাই বারণ। স্কুলের সিংহদুয়ারে বসিয়ে দাও দুজন অস্ত্রধারী পুলিশ।

আমলাতন্ত্র মায় মন্ত্রী পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় মাতব্বরদের চ্যালেঞ্জ জানাও তুমি। মানবতা অপমানিত,লাঞ্ছিত এর চেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় আর কি হতে পারে? প্রজন্মের আগামীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবে,তার স্বপ্নকে ভাঙচুর করে দেবে রাষ্ট্র? মন্ত্রী আমলাদের জবাবদিহি করতেই হবে। এত বড় দুঃসাহস তোমার! মন্ত্রীদের পদত্যাগ চাও? তুমি বলো, মানুষের চেয়ে কি মন্ত্রী বড়? রাষ্ট্রকে সহবত শেখাও তুমি। যার বুকে কলঙ্কের দাগ নেই তার তো বিনয় থাকে না, তার থাকে স্পর্ধা। তোমাকে দেখে বঙ্গোপসাগরীয় উপকূল আশ্চর্য হতবাক হয়ে যায়।

রাষ্ট্র চালকের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসেব চাইবার আপোষহীন উচ্চারণ তোমার কন্ঠে। কোথাকার শান্তি প্রসাদ কল্যাণময়! কে পরেশ,কে পার্থ? শব্দ তো একটাই মানুষ।

মন্ত্রীর কন্যা তাতে কি আসে যায়! অবৈধ অযোগ্য নিয়োগ স্তব্ধ করে দাও ন্যায়ালয়ের টেবিলে হাতুড়ির আঘাত এনে– মাইলর্ড!
প্রজন্মদের রক্ত ঘাম অশ্রুমাখা পাঁচশো কোটি টাকা পকেট এ ভাবে পুরে নেবে গণতন্ত্রের প্রহরীরা? অথচ মুখে তাদের মা-মাটি-মানুষের স্লোগান, ভাবা যায়!

শিক্ষা আনে চেতনা। চেতনা আনে বিপ্লব। শিক্ষা সংক্রান্ত মামলার দেখভালের দায়িত্ব তোমার হাতে। বাতাসও কথা বলে। এই যে এখানে বসে আছে জনগণের বিচারপতি।

তোমার এজলাসে দাঁড়িয়েই কে ক্ষমা চেয়েছিল? মনে পড়ে রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতি।তার উদ্দেশ্যে তুমি কি বলেছিলে? স্মৃতির ঘরে এখনো অর্গল পড়েনি আমার— আপনাকে অপমান করার কোন উদ্দেশ্য আদালতের নেই। আপনি ল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তার পরেও আপনি আইনকে অবহেলা করেছেন?

একটি রাত এখানে নৈতিক দায়বদ্ধতার রাত হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক। ১৮ মে ২০২২, বুধবার। প্রজন্মের অধিকার পদদলিত করতে পারে রাষ্ট্র, নথিপত্র বেমালুম গায়েব করে দিতে পারে রাষ্ট্র– সন্দেহ জনমনে। খুলে গেল আদালত। তখন রাত সাড়ে এগারোটা। শুনানি চললো। হায় আচার্য ভবন! সিল করে দেওয়া হলো ডাটাবেস এবং এই সংক্রান্ত কয়েকটি কক্ষ। দরোজায় বসিয়ে দেয়া হলো সশস্ত্র প্রহরী।শাসক মুখ গোমড়া করে বসে রইল। জাগরণের স্বপ্ন দেখাও তুমি!

হাড়হিম স্রোত বয়ে যায় কাদের শিরদাঁড়ায়? কাদের ঘুম কেড়ে নাও তুমি? মৌসুমী জলবায়ুর দেশ। এখানে এখনো বৃষ্টিপাত হয়। বীজতলায় ধানগাছগুলি বেড়ে ওঠে। আকাশে ওঠে হিরন্ময় রোদ। সমুদ্র উপকূলের লবণাক্ত জলবায়ুর প্রতিকূলতা দুহাতে সরিয়ে দিয়ে বাতাস বলে চলে — ১৭ নম্বর এজলাস! ১৭ নম্বর এজলাস!