অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদন

২০০০ টাকা নোটের গল্প

তমাল সাহা

দুই হাজার টাকার নোট উঠিয়ে নিচ্ছে না বাতিল হয়ে যাচ্ছে, এ দুটি শব্দের মধ্যে কি পার্থক্য আমি বুঝবার চেষ্টা করি। কিন্তু এদিকে দু হাজার টাকার নোট বাতিল নিয়ে রাজনৈতিক এবং অর্থনীতিবিদ মহল এর ভালো মন্দ নিয়ে হামলে পড়েছে এবং বিতর্ক উঠেছে।

আমার মতো সাধারণ মানুষের বিদ্যাবুদ্ধিতে নোট বাতিলের প্রভাব নিয়ে তেমন কোন ভাবের উদ্রেক হয়নি। সেবারের নোটবন্দির বিষয়ে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া এবং তার পরিণতি সম্পর্কে আমার বিশদ জানা থাকলেও এবার এ বিষয়টিকে আমি তত গুরুত্ব দিইনি বা দিই না।

নোটের এই ঘটনা সম্পর্কে অনেকের অবশ্যই একটু ইতিহাসের কথা মনে পড়ে। অন্তত পক্ষে একবার হলেও উচ্চারিত হয় মোহাম্মদ বিন তুঘলকের নাম এবং তার সঙ্গে জুড়ে থাকবেই খামখেয়ালিপনা বা পাগলামি শব্দ দুটি।

বড় বড় কাগজে বড় বড় আলোচনা পড়ে শেষ পর্যন্ত আমিও সক্রিয় হয়ে উঠি। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত আমারও তাই। এখন তো খরদাহ। সেই মার্তণ্ডের তেজ উপেক্ষা করে আমি কাঁচরাপাড়া স্টেশনে চলে যাই যারা ফল-ফলাদি বিক্রি করে। একজনের কাছে জিজ্ঞাসা করি, তোমার কাছে দুহাজার টাকার নোট আছে? সে বলে, নেই। এবং আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকে। মনে করে কোনো ইনফরমার বা খোঁচড় । কজন ফলওয়ালা আমার পরিচিত মদনবাবু রফিক মন্ডল প্রফুল্ল দাস এরা সবাই ঋতু পর্যায়ের এবং অসময়ের ফল বেচে।

এই অনুসন্ধানে আমাকে দেখে তারা কয়েকজন আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। একজন বলে, অনেক বাবুরা দু হাজার টাকার নোট দেয় কিন্তু নিতে পারি না। ফেরত খুচরা টাকা দিমু কেমন কইরা? তখনো অত টাকার বিক্রি হয় নাই!

ইস্টিশনে কয়েকজন ভিখারিকে দেখে ক’জনের হাতে পয়সা দিয়ে দানী হয়ে যাই এবং জিগ্যেস করি, এত দিন যে তোমরা ভিক্ষা করছো ২ হাজার টাকা জমেনি? ওরা মুখ ব্যাজার করে বলে, দুই হাজার টাকা! এমন টাকা তো আমরা বাপের জম্মেও চক্ষে দেখি নাই।

এরপর আমি চলে যাই লাইনের পাশে গড়ে ওঠা সূর্যনগর কলোনিতে। বস্তির ঝোপড়িতে কয়েকটা ঘর খুঁজে দেখি তাদের কারো কাছে ২হাজার টাকার নোট আছে নাকি! ব্যর্থ তো বটেই হতাশ হয়ে পড়ি।

আমার দৌড় মণ্ডল বাজার, কাছারি বাজার গঙ্গাঘাট রামপ্রসাদের ভিটে সতীমার মেলা ইটের ভাটা বারুদপাড়ার গঙ্গাপারের বসতি এই পর্যন্ত।

রামপ্রসাদের ঘাটে ভিখিরিরা বসে আছে‌ সামনে বাটি। বাটিতে চাল ডাল সঙ্গে পাঁচ টাকার কয়েন ১০ টাকার নোট মিশে আছে। পাশে রাতে শোবার পর গায়ে দেবার কম্বলও রাখা আছে। পরপর তাদের জিজ্ঞাসা করি, তোমরা শীতে কম্বল পাও, চাদর পাও শাড়ি পাও। কেউ তোমাদের কোনদিন দুই হাজার টাকা নোট সাহায্য দিয়েছে? তারাও বলে না।

রামপ্রসাদের ভিটেতেও যাই। অনেক ভক্তজনকে মন্দিরে অনেক কিছু দিতে দেখি হাতে ৫০০টাকার নোটও দেখি কিন্তু ২ হাজার টাকার নোট দেখি না।

সেখান থেকে চলে যাই আচার্য পাড়া ভাঙ্গড় পাড়ার বারুদ বস্তিতে যারা বাড়িতে বাড়িতে আতশবাজি বানাচ্ছে। তাদের হাত রুপালি বারুদে ছেয়ে গেছে কিন্তু তাদের হাতে কোনো দু হাজার টাকার নোট দেখি না।

ইটভাটার বস্তিতে যাই তখন বেলা একটা। কোনো মজুর-মজুরানির কাছে দু হাজার টাকার নোটের সংবাদ পাইনা। তারপর চলে যাই সতীমার মেলায়। ডালিম তলায় বসে থাকি অনেকক্ষণ। অনেকেই ডালিম গাছে মাটির ঘোড়া বাঁধে। ডালিম তলায় টাকা পয়সা ছুড়ে দেয়। কাউকেই দু হাজার টাকার নোট দিতে দেখিনা।

মন্ডল বাজার ও কাছারি বাজারের মাঝারি ব্যবসায়ীদের আমার খুব চালাক বলে মনে হল। তারা বলে আমরা সাধারণত দু হাজার টাকার নোট নিই না।

আমি বলি, কেন নেওনা?

তারা বলে,বাজারে এখন দু হাজারের উপর কোনো বড় নোট নেই। নোটবন্দির পর আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছি এবং অনেকটাই বুঝে গেছি এই দু হাজার টাকার নোটও একদিন বাতিল হতে পারে। এই আতঙ্কে আমরা ২ হাজার টাকার নোট নেই না।

ভারতবর্ষে নাকি ১৪০-৪৫ কোটি লোক। দুই হাজার টাকার নোটগুলো গেল কোথায়! গাঙ্গেয় উপত্যকার মানুষ অবশ্য বান্ডিলের পর বান্ডিল ২হাজার টাকার নোট দেখেছে! সে তো রাজনৈতিক নেতাদের ঘরে। মন্ত্রীর ঘরে, মন্ত্রীর চুমুছোঁয়া নারীর ঘরে, যুব পৌর নেতাদের ঘরে, তাদের বান্ধবীদের ঘরে।

তাহলে ২ হাজার টাকার নোট ব্যাংকে জমা দিতে হবে কাদের? কারা কালো টাকা তৈরির জন্য বান্ডিল বান্ডিল ২ হাজারি নোট রেখে দিয়েছে ঘরে? এদিকে জানা গিয়েছে

এই বঙ্গীয় রাজ্যে বদল হবে ১০০ কোটি টাকার দু হাজার টাকার নোট। এগুলি সবই তদন্তকারী সংস্থার উদ্ধার করা অবৈধ টাকা।

তাহলে এই ২ হাজার! ২ হাজার টাকার নোট বাতিলের জন্য আমরা সাধারণ মানুষ এত চাপ নিচ্ছি কেন? নোটবন্দির বিষয়টি তো আমাদের জানা আছে। নোটবন্দির ফলে আমাদের খিদে আরো বেড়েছে না কমেছে? আমরা তো সেই তিমিরেই আছি। আমাদের সাধারণ মানুষজনের তো আর টাকা জমাট দেবার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে না!

তবে ২ হাজার টাকার নোট যখন নতুন বেরোয় তখন কৌতূহলী ছিলাম। নতুন নোটের আসল নকল বুঝতে হলে নাকি ওখানে লুকিয়ে থাকা একটা চিপ থেকে আলো আর কি সব বেরোয়! ২ হাজার টাকার নোট হাতে নিয়ে আমি নিজে এই ক্রিয়াকলাপটি কোনমতেই দেখতে পাচ্ছিলাম না। তখন আমার সহযোগী রঞ্জন এবং আমার পুত্র দেখায় যে ওই দেখো! দুঃখ এই অভিভূত দৃশ্যটি আমি আর কোনোদিন দেখতে পাবো কিনা জানিনা!