আজ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবস। তার জন্মদিন পালনকে কেন্দ্র করে একটি হত্যাকাণ্ডের কথা লিখি

১৬ সেপ্টেম্বর সেই কালো রাতঃ
পাগলা ঘন্টি বাজিয়ে হত্যাপর্ব
তমাল সাহা

১৯২৫ সাল। লেখা হয়ে গেছে বিদ্রোহের উচ্চারণ। রাজরোষে পড়ে গেছে শরৎচন্দ্র। তখন তো পথের দাবী’র লেখক রীতিমতো সব্যসাচী। কখন কি বেশ ধরেন কে জানে—গিরিশ মহাপাত্র? পথের দাবী নিয়ে উত্তাল সময়। শরৎচন্দ্রের সমর্থনে তেমনভাবে দাঁড়ালেন না রবীন্দ্রনাথ।

সেটা ১৯৩১ সাল। বিপ্লবীরা ঠিক করলো এমন দুর্দান্ত কলমওয়ালার জন্মদিন পালন করবে তারা। তারা তখন রাজনৈতিক বন্দী হিজলি জেলখানায়।
সেবার শরৎচন্দ্রের জন্মদিন পড়েছিল ১৭ সেপ্টেম্বর, ৩১ ভাদ্র।

রাত তো বাড়ছে। রাত তো গভীরতার দিকেই যায় এবং যাবেই। ১৬ সেপ্টেম্বর। রাতে বিপ্লবীরা শরৎ জন্মজয়ন্তী পালনের পরামর্শে বসেছে। আলোচনা চলছে। মেদিনীপুরের মাটি বিপ্লবীদের দুর্জয় ঘাঁটি‌। খড়্গপুর হিজলি জেল আগুনখোর অস্ত্রীরা।
তখন জেল কমান্ডেন্ট বি এইচ বেকার এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রবার্ট ডগলাস।

ইতিমধ্যে আগের দিন ১৫ সেপ্টেম্বর লন্ডনে হয়ে গিয়েছে গোল টেবিল বৈঠক। মহাত্মা গান্ধী ও আরউইনের আলোচনা। আর সেই দিনই গভীর রাতে হিজলি বন্দীনিবাস থেকে কড়া নজরদারি এড়িয়ে পুলিশের চোখে রীতিমতো ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেলেন বিপ্লবী ফণি দাশগুপ্ত, চিন্তামণি দাস ও নলিনী দাস।

প্রশাসনিক পরিকল্পনা তো ছিলই। ইতিমধ্যে ৭ এপ্রিল ১৯৩১ নিহত হয়েছেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেমস পেডি সাহেব বিপ্লবী জ্যোতিজীবন ঘোষ এবং বিমলেন্দু দাশগুপ্তের আগ্নেয় কার্তুজে।
পেডি সাহেব মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে প্রদর্শনী দেখতে গিয়েছিলেন।
কিভাবে পালন করা হবে শরৎচন্দ্রের জন্মদিনটি আলোচনা শেষের মুখে। তখন রাত সাড়ে নটা।
পাগলা ঘন্টি বেজে উঠলো। বন্দীদের ঘিরে গুলি চালনা শুরু হল। অর্ডার মিল গিয়া। বদতমিজ কো মার ডালো। এই প্রথম জেলখানায় রাজবন্দীদের ঘিরে হত্যার ঘটনা ঘটলো পরাধীন ভারতবর্ষে।

নিহত হলেন সুভাষচন্দ্রের সহপাঠী সন্তোষ কুমার মিত্র। প্রেসিডেন্সি কলেজে স্নাতকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন। তার তলপেটে লাগল পরপর দুটি গুলি। নিহত হলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের নেতা মাস্টারদার সহযোগী তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। জখম ও আহত হলেন বিপ্লবী প্রভাত মল্লিক, গোবিন্দ দত্ত, শশী ঘোষ সহ ৪০ জন।

নির্বিচারে হত্যার প্রতিবাদে বন্দীদের শুরু হলো অনশন আন্দোলন। তখন মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস।
নিহত দুই শহীদকে সামনে রেখে চলল আন্দোলন।
শেষ পর্যন্ত ১৮ সেপ্টেম্বর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস নেতা যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গেলেন হিজলি জেলে। এই দুই মহান শহীদের দেহ বিশেষ কফিনে নিয়ে ফিরলেন কলকাতায়। রবীন্দ্রনাথ এই ঘটনায় রীতিমতো ক্ষুব্ধ। তিনি প্রতিবাদে লিখলেন ‘প্রশ্ন’ কবিতাটি– যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু,/ নিভাইছে তব আলো,/ তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, /তুমি কি বেসেছো ভালো?

২৬ সেপ্টেম্বর কলকাতার শহীদ মিনারে হলো বিশাল জমায়েত। সেই জন সমাবেশে সভাপতিত্ব করলেন রবীন্দ্রনাথ নিজে এবং তিনিই ছিলেন প্রধান বক্তা। অন্যান্য বক্তারা ছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, স্যার নীলরতন সরকার, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, মোঃ আক্রম খাঁ এবং ঊর্মিলা দেবী।

এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কারণে হিজলি জেল শিরোনামে চলে এলো। মেদিনীপুরের মাটি বিপ্লবের পীঠস্থান। তাকে বলা হয় ল্যান্ড অফ রিভোল্ট। এই বিশাল হিজলি জেলেই প্রথম মহিলা বন্দীদের রাখবার ব্যবস্থা হয়।
পরাধীনতার কালে এই জেলেই কোনোদিন বন্দী ছিলেন চার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি প্রফুল্ল সেন প্রফুল্ল ঘোষ নৃপেন চক্রবর্তী। এই জেলেই বন্দী ছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত বিশ্বনাথ মুখার্জি আব্দুল হালিম নরেন সেনের মত বামপন্থী নেতারা।

হিজলি জেলের মহিলা সেলে বন্দী ছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা সুহাসিনী গঙ্গোপাধ্যায় বনলতা দাশগুপ্ত লীলা নাগরায় ইন্দুমতি ঘোষ সরোজআভা নাগ বীণা দাস কল্পনা দত্ত শান্তি দাস কমল দাশগুপ্তর মত নেত্রীরা।

১৬ সেপ্টেম্বরের সেই ভয়ঙ্কর কালো রাত, রক্তঝরা রাত! তোর কি স্মরণে আছে রে গাঙ্গেয় প্রদেশ?