আজ ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়ের প্রয়াণ দিবস

হালিশহরেও সতীদাহ হয়েছিল
তমাল সাহা

সে রামমোহন রায়ের জন্মদিন মৃত্যুদিন যাই হোক তার কথা উঠলেই মনে পড়বেই সতীদাহ- সহমরণ-অনুমরণের কথা।
আমি যত্তসব ভাবি হাবিজাবি। রামায়ণের কালে সীতার সতীত্ব পরীক্ষা হয়েছিল অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে। সীতা পাতাল প্রবেশ করেছিলেন তখন রামচন্দ্রের রাজত্বকাল। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার নাম রাম রাজত্ব। রাজত্বকাল এই ঘটনার জন্য দায়ী নিশ্চিত।
সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদে যিনি সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন তার নামের পূর্বেও রাম শব্দটি থাকায় আমি চিন্তিত হয়ে পড়ি। রামমোহন রায় যে ছদ্মনাম নিয়েছিলেন সেই নামও ছিল রামচন্দ্র দাস।
তবে রাম মানে কি? প্রকৃতপক্ষে রাম শব্দটি তাৎপর্যবাহী। রামের অর্থ বিশাল।

একবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ যখন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সতীতে পরিপূর্ণ তখন কারা যেন সতী! সতী! রবে নটরাজের বিভঙ্গে নৃত্য শুরু করে দিয়েছে। সতীত্বের এই গোলক ধাঁধা য় এখন মানুষ দিশেহারা হয়ে এতোল বেতোল ছুটছে।
সতী দাহ প্রথা কুসংস্কার এ তো জানা হয়ে গিয়েছে। এই ডিজিটাল যুগে রাষ্ট্র যখন মদত দেয় আর রাষ্ট্রীয় মস্তানেরা একের পর এক ধর্ষণ কাণ্ড ঘটিয়ে ভারতবর্ষকে ধর্ষক উপত্যকায় পরিণত করে বিশেষ মাত্রা পায় তখন তোমার কেমন মনে হয়? ধর্ষণ গণধর্ষণের পর খুন করে দাহপর্ব চলছেই, তাকি তৎকালীন সতীদাহ প্রথাকে হার মানায় নি?এই অবস্থায় যদি বলি ভারতবর্ষ আধুনিক হয়েছে সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে তখন কি পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা স্তব্ধ করে দেবে?

ছবিঃ বিংশ শতাব্দীর সতীদাহস্থল। উত্তরপ্রদেশের মাহোরা জেলার সাতপুরওয়া গ্রাম। মানুষ প্রণাম ও দর্শন করছে সেইস্থল।

উত্তর প্রদেশের মাহোরা জেলায় সাতপুরওয়া গাঁয়ে চরণ শাহ সতী হয়েছিলেন ১১ নভেম্বর,১৯ ৯৯ বৃহস্পতিবার। সেই সতীস্থল দর্শনে কাতারে কাতারে ছুটেছে মানুষ ফুলমালা আর মাঙ্গলিক নারকেল হাতে নিয়ে। প্রণাম করেছে সতীস্থল।
১৮২৯ সালে বেন্টিক সাহেব- রামমোহন রায় সতীদাহ নিবারণে আইনি পদক্ষেপ নিলে কি হবে ভারতীয় মহান দেশে ধর্মীয় তেজ এতই প্রবল যে তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ১৯৮৭ সালে তা আবার চাগার দিয়ে ওঠে রাজস্থানের দেওরালা গ্রামে রূপ কানোয়ারকে সতী বানিয়ে দেয়। যাক সেসব কথা।

ছবি: ১৯৮৭ সালে সতীদাহ প্রথার শেষ বলি রূপ কানওয়ার

আমাদের ২৪ পরগনা জেলার বারাকপুর মহকুমাও সতীত্বের বিচারে নিশ্চিত পিছিয়ে থাকতে পারে না।
সেসময়ে সতীদাহ প্রসঙ্গে বিস্তারিত সংবাদ প্রতিবেদন বেরিয়েছে সমাচার দর্পণে। সতীদাহের সংখ্যা কত, ক্রমাগত সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তার কারণ, এসবই পরিজ্ঞাতর জন্য সমাচার দর্পণ উল্লেখযোগ্য।

এই শহর কোনদিন সতীত্বের মহিমায় গরিয়সী হয়েছিল তা জানতে পারছি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ প্রথম খণ্ড থেকে। এক পত্রলেখক আমাদের এই অঞ্চলের একটি সতীদাহের বর্ণনা দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন সমাচার দর্পণে, ৫ মে ১৮২৭ অর্থাৎ ২৩ বৈশাখ ১২৩৪ সালে। তার লেখা পত্রাংশ হুবহু তুলে দেয়া হলো– ‘ হালিশহর পরগণায় গরিফা গ্রামে ২২ বৈশাখ এক ব্রাহ্মণের কন্যা বাইশ বৎসর বয়স্কা নিজপতির শবের ক্রোড়ে সতী হইয়াছে, তাহার পূর্ব বৃত্তান্ত আমি অজ্ঞাত কিন্তু তাহার তৎকালের অবস্থা অবলোকন করিয়া চিত্ত আর্দ্র হইল। নরবলি, গঙ্গা জলে মনুষ্য বালক জীবদ্দানকরণ ও রথের চাকার নীচে গাত্র চালন পূর্বে ছিল তাহা হইতে ভয়ানক সহমরণ অনুমরণ ভদ্রলোকের দর্শনে বোধ হয়। কারণ অবলা অনভিজ্ঞ স্ত্রীলোককে শাস্ত্রোপদেশ দ্বারা ভ্রম জন্মাইয়া এরূপ উৎকট কর্মে প্রবৃত্তকরাণ সাক্ষাৎ যমদূতের ন্যায় হস্তধারণপূর্ব্বক ঘুর্ণপাকে সাতবার ঘুরাইয়া শীঘ্র চিতারোহণ করাইয়া শবের সহিত দৃঢ়বন্ধন পুরঃসরে জলদগ্নিতে দগ্ধকরণ ও বংশবদয় দ্বারা শবের সহিত তাহার শরীর দাবিয়া রাখন ও তাহার কথা কেহ না শুনিতে পায় এ নিমিত্তে গোলমাল ধ্বনিকরণ অতি দুরাচার নির্মায়িক মনুষ্যের কর্ম এমত বিষয়ে তাহার সাহায্যকারি ও সঙ্গিলোক সকলেই দোষী হইতেছেন। শাস্ত্রের ভালোমন্দ পরমেশ্বর জানেন আপাতত শাস্ত্র দেখাইয়া এমত কর্মে প্রবৃত্ত হওন কিম্বা করান বিশিষ্ট লোকের অনুচিত।’ নিজ মহকুমায় ঘটে যাওয়া এই পুরাতন ঐতিহ্য বুকে আগলে রাখতে কি খুবই ভালো লাগছে?
সতীদাহ ও রামমোহনকে বিষয় করে যত না পড়ি তার চেয়ে পর্যবেক্ষণের দিকে আমার জোর বেশি। আমি হৃষীদাকে বলি পর্যবেক্ষণে স্বাস্থ্য ভালো হয়। সে বলে, তা কেমন? আমি বলি,হেঁটে হেঁটে তো দেখতে হয়। পায়ের পেশিশক্তি মজবুত হয়। হাত নড়াচড়া করে। তাই হাতও মজবুত হয়। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে দেখতে কথা হয়, ভালো ভালো কথা। সুতরাং মুখেরও ব্যায়াম হয়। আর চোখ? সে তো বিশাল ব্যাপার? দৃষ্টিশক্তি বাড়ে।চাট্টিখানি কথা দাদা?
সে পানখাওয়া মুখে খড়কে দিয়ে খুঁটতে খুঁটতে বলে, তোর কথায় জাদু আছে।
যাক আমি বলি সতীঘাট দেখতে যাবো। একদিন গেলাম। সেটা বরানগর পুরসভার অন্তর্গত মত চৌধুরী স্ট্রিটের গঙ্গার পারে। সেখানে এখন রামমোহন রায়ের স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলা হয়েছে। ১৭৮৯ সাল থেকে ১৮০৯ সাল পর্যন্ত সতীদাহ হয়েছিল।
তুলো ব্যবসায়ী বড়লোক দত্ত রাম চট্টোপাধ্যায়। তার বাড়ি ডাকাতি হয়ে গেল। তাকে খুন করে চলে গেল দুষ্কৃতীরা। তার শেষযাত্রায় সহমরণে গেলেন তার স্ত্রী।
লেখক স্বপন বসুর ‘সতী’ নামক গ্রন্থে লেখা আছে, কামারহাটির কৃষ্ণদেব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে পালকি চেপে তার বৃদ্ধাস্ত্রী বরানগর এই ঘাটে ছুটে এসেছিলেন সতী হতে।

রেভারেন্ড বুচাননের বই থেকে ১৮০৪ সালের ১৫ ই অক্টোবর পর্যন্ত ওই অঞ্চলে সতীদাহের সংখ্যা জানা যায়। সেই সময়ে বরানগরে ২, কাশীপুরে ১, চিৎপুরে ২, দক্ষিণেশ্বরে ২, আগরপাড়ায় ৪ আড়িয়াদহে :৩টি সতীদাহের ঘটনা ঘটে। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৮০৯ সালে একজন ধোপা গোষ্ঠীর অন্তর্গত জনৈকা মহিলার সতীদাহের সংবাদ পাওয়া যায।

আরেকটি ঘাটের কথা শুনেছিলাম। দক্ষিণ কলকাতার হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের অদূরে বলরাম বসু ঘাট রোড রয়েছে। সেখান থেকে এগিয়ে গেলেই আদি গঙ্গার পারে বলরাম বসু ঘাট। এখানেও সতীদাহ হয়েছিল বলে জানা যায়। এখানে সতীদাহ ঘাট লেখা একটি ফলকে আছে। তবে এ নিয়ে প্রচুর বিতর্ক রয়েছে।

মুর্শিদাবাদ জেলার কাশিমবাজার এক বিশাল বাণিজ্য কেন্দ্র। সেখানে গঙ্গার পারে রয়েছে সতীদাহ ঘাট। সেই ঘাটেই রয়েছে বিখ্যাত পাতালেশ্বর মন্দির।