সমরেশ নামে বাংলা সাহিত্যে জাদু আছে

সে আমাকে দৌড় করিয়েছিল রেসের মাঠে
তমাল সাহা

নিশ্চিত সে সময় ঝড় উঠেছিল। সে ঝড়েরও নাম ছিল। ঝড় উঠেছিল ডুয়ার্স তরাই অঞ্চল তিস্তা তোর্সা নদীর সীমা ছাড়িয়ে সমগ্র দক্ষিণ মহাসাগরের তীরে। বঙ্গোপসাগরের পারে লবনাম্বু উদ্ভিদেরা,সমতল ভূমের বৃক্ষেরা সেসব ভালো করে জানে। জলস্রোতে ও পললমাটিতে রক্তধারা মিশে ছিল। সেই রাজনৈতিক প্রবাহে তার জন্মভূমেও রক্ত ঝরেছিল। জন্মভূমির মাটি পরিবেশ নিশ্চয়ই তাকে সেই আগ্নেয় রাজনীতিতে পক্ষপাতদুষ্ট করেছিল এবং সেখানে সে জীবনের কোনো সুসংবাদের গানও বোধ করি শুনতে পেয়েছিল। তখন আমার বয়স উনিশ তার বয়স হবেও বা পঁচিশ-ছাব্বিশ।

আত্মম্ভরিতা বা আত্মপরিচয়ের অহমিকা নয় দেখা হয়েছিল, কথা হয়েছিল, কোথায় কখন তা অনুক্ত থাকাই ভালো। কারণ সহযোদ্ধা না হলেও পেশাগত কারণে আমরা তো সহকর্মী ছিলাম।

সে-ই দায়ী। সে-ই আমাকে ঘোড় দৌড়ের মাঠের প্রলোভন দেখিয়েছিল। দৌড় দেখেই আমি জীবনে প্রথম ঘোড় দৌড়ের মাঠে যাই। আমার পিছনে তখন স্বামী বিবেকানন্দের বিশাল প্রতিকৃতি দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছিল। পরিচয় হয়েছিল সাতাত্তরে। দৌড় দেখি উনআশিতে। রেসকোর্সের মাঠে মেম্বারশিপের আইডেন্টিটি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে। আমার পরিচিত তখন কত বড় বড় ধনী লোক যারা নিয়মিত কেস করতে আসছে। কাজের দৌলতেই রেসের মাঠের মেম্বারশিপের কার্ডটি আমার জুটে যায়। আর সেসময় আমার প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রীতিমতো দোস্তি। প্রদীপ দার মত মানুষ একদিকে ইনকাম ট্যাক্সের উকিল অন্যদিকে এমন অভিনেতা হয় কী করে এ ঘোর এখনো আমার কাটেনি। প্রদীপ দা নেই । তার মতো এতো শান্তশিষ্ট মানুষকে কী আমি ভুলতে পারি! প্রদীপ দা ছিল দৌড় চলচ্চিত্রের নায়ক রাকেশ মিত্র। আমি নিয়মিত তখন তার কাছ থেকে উপঢৌকন পেয়েছি একটি করে কোল্ড ড্রিংকসের বোতল এবং লম্বা সাইজের সিগারেট। কারণ সে নিয়মিত কাজ করতে আসতো আমার দপ্তরে। তখন সেই ঝড় যার নাম আগে উল্লেখ করিনি,সেই ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’ স্তিমিত হয়ে এসেছে। দৌড় উত্তাল সময়ের রাজনীতি রাষ্ট্রীয় অবস্থান, সামাজিক প্রেক্ষিতকে বিষয় করে গড়ে উঠেছিল।

সমরেশ নামে ব্যঞ্জনা আছে। মধ্যবিত্তদের নাম এমনই হয়। যদিও মধ্যবিত্ত বিষয়টি এখনো আমার কাছে দুরূহ। কতখানি বিত্ত হলে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত বলা যায় তা আমি জানিনা।
দেশ ছেপেছিল তার দৌড় ১৯৭৫ সালে। দেশ-এর সাফল্যেই তো আমাদের মতো লেখকদের দৌড়ের গতিবেগ বেড়ে যায়। তার ওপর দৌড় চলচ্চিত্র হয়ে বেরুল ১৯৭৯ সালে শঙ্কর ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় মধ্যবিত্ত জীবন চেটে খাওয়া মুন্সিয়ানায়। তখনো বিপ্লব ঘুরছে মধ্যবিত্তের আশ্চর্য মাথায়।
স্বীকার করি এই ঝরাপাতা বেলায় কিছু টাকা লাভ হলেও দৌড়ের মাঠ থেকে শেষ পর্যন্ত ফতুর হয়ে ফিরেছিলাম এক এক বোতল বিয়ার খেয়ে সন্ধ্যেবেলায়। বলুন তো এতো মধ্যবিত্ত সুখ আর আমি পাবো কোথায়? রেসের মাঠে সত্যি উত্তেজনা আছে। তার বাস্তব অভিজ্ঞতা তো অর্জন হয়েছিল পরোক্ষভাবে সমরেশদার দৌলতেই।

মাধবীলতা ও অনিমেষ বড় কথা নয় সমরেশদা বুঝে গিয়েছিল মধ্যবিত্ত পাঞ্চ ককটেল মিশেল— পার্বত্য নিসর্গমালা, নদীর জোয়ার ভাটা, প্রকৃতির আশ্চর্য বিবরণ আর নস্টালজিক উপাদান তার সঙ্গে মধ্যবিত্তের বিপ্লবের স্বপ্ন, ব্যর্থতা, নারীর মহিমা যাদুকরী দ্বন্দ্বের স্পর্শের ব্যাপকতা। সমরেশদা কালবেলা কালপুরুষ উত্তরাধিকার উপন্যাসে নিশ্চিত মধ্যবিত্ত প্রজন্মকে যারা ৭০ দশক দেখেনি তাদের বৈপ্লবিক রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন করেছে। পাঠকেরা বুঁদ হয়ে নেশাগ্রস্ত হয়েছেন। আমার ধারণায় এরপর আর কোনো উপাখ্যান না লিখলেও মধ্যবিত্ত চেতনায় যুবরাজ হয়ে থাকতে পারতো সমরেশ দা।

শব্দ কিভাবে সাজালে কতদূর গেলে বিপ্লবী হওয়া যায় কে জানে! চরম বিপ্লবীরা অনেকেই বলেছে এইসব বিপ্লবীয়ানা রোমান্স– অন্তঃসত্ত্বা হওয়া, জেল খেটে আসার পর পঙ্গুত্ব, বিবাহের ভাবনা, নারীত্বের গুরুত্ব তাদের আত্মত্যাগ– এসব নাকি মধ্যবিত্তরা ভালই ‘খায়’। পাঠক মনের মানুষেরা শেষ পর্যন্ত বই ছাড়া আর কিছুই খায় না। সেই গরিব বা ধনীরা আবার গল্প উপন্যাস পড়ে নাকি! চরম মনোভাবাপন্ন বিপ্লবীরা সমরেশদার বিরুদ্ধাচারণই করে। বিপ্লব চর্চাকারীরা ঘরে বসে কী করছে কে জানে?

আমি শুধু জানি মধ্যবিত্তরা বিপ্লবের চিন্তায় সুখ পায়। তারাই অন্ধকারে ডিবরি বাতি জ্বালিয়ে দেয়ালে বিপ্লবী স্লোগান লেখে, জেলখানায় গুলিও খায়,ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনেও দাঁড়াতে জানে, তাদের লাশ কোনো গোপন অন্ধকারে ভেসেও যায় জলস্রোতের বানে। মধ্যবিত্তরা কিছু করেনা কী করে বলি?

তার কালবেলা ও চলচ্চিত্রায়িত হয়েছিল। সেই নির্দেশকও নামজাদা গৌতম ঘোষ। তিনিও জানি বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের পথে হেঁটেছিলেন কোনদিন। ভারতবর্ষ জুড়ে এখন দক্ষিণা বাতাস। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার হামলে পড়া বাতাস কত দিন মধ্যবিত্ত চেতনাকে সামলাতে পারে? সমরেশ দা জ্ঞানপাপী হয়েও এ বিষয়ে লিখেছে।
বিশেষ করে কালবেলা পড়ে অনেক অবিপ্লবী প্রজন্ম নকশালবাড়ি আন্দোলনের একটা রোমান্টিসিজম যাই বলা হোক স্পষ্ট অস্পষ্ট ছবি, পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুভবের বাঙালিসুলভ উত্তেজনা এবং সিল্যুয়েট ছবি নিশ্চিত খুঁজে পেয়েছিল তা অস্বীকার করি কী করে এবং নকশালবাড়ি আন্দোলন সম্পর্কে অতীতের ঘটনাপ্রবাহ জানবার একটি অভীপ্সা তাদের চেতনাকে অবশ্যই নাড়িয়ে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর জাত-বুর্জোয়া অবস্থান স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি ময়মনসিংহ গীতিকা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। শ্রেণীগত অবস্থান সম্বন্ধে সচেতক রবীন্দ্রনাথকে তা মুগ্ধ করেছিল। আমাদের মতো মধ্য মেধাসম্পন্ন বলে কথিত এমন মানুষেরা নিজেরা শ্রেণীগত অবস্থান মোটামুটি বুঝলেও রবীন্দ্রনাথকে কি অস্বীকার করতে পারি? সমরেশ দা বিপ্লবী লেখক না হলেও মধ্যবিত্ত পাঠকদের কাছে সাড়া জাগানো লেখক হয়ে উঠেছিল, সময় তো তেমনই বলে।

শব্দ গেঁথে ভারত রাষ্ট্রীয় পুরস্কার অর্জন এবং বঙ্গোপসাগরীয় বিভূষণে বিভূষিত হয়েছিল সমরেশদা। সত্যসন্ধানী অর্জুনও লিখেছিল বঙ্গীয় সাহিত্যের ময়দানে।

ধনী লোকেরা এসব সাহিত্য-টাহিত্য তো পড়ে না, মধ্যবিত্ত পাঠকেরা এসব পড়ে। রাগে অনুরাগে ভালো মন্দ এসব কথা বলে! নিখুঁত মানুষ, মনের ইচ্ছেমতো মানুষ পাওয়া গেছে কোন যুগে কোন কালে? মধ্যবিত্ত পাঠকরাই তো লেখকের জনপ্রিয়তার শক্তি নির্ণয় করে!

তাহলে গল্পের মরাল দাঁড়ালো এই নকশালবাড়ি আন্দোলন সংঘটিত না হলে সমরেশদা সাহিত্যিক সমরেশ হতে পারতেন কি করে? এমন যদি বলি নকশালবাড়িকে পণ্য করে সাহিত্যের বাজার ভালোই চলে, তবে কি কিছু ভুল হবে? একটি দশকে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতি জগতের মানুষদের জনপ্রিয়তা যশ বাড়িয়ে দিয়েছিল তা নিশ্চিত ভারতীয় আর্থসমাজিক ও রাজনীতির ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবে।