অঞ্চলের পালা গানকার লোকগীতিকার শ্যামসুন্দর দাস চলে গেলেন বুধবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

শ্যামসুন্দর দা আরেকবার ঘুরেফিরে নাচো গো!

তমাল সাহা

পাখি কতক্ষণ আর খাঁচায় থাকে? শেষ পর্যন্ত খাঁচা ভেঙে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল পাখিটা বুধবার।

পাখি গান গাইতে গাইতে উড়ে যায় আকাশ পানে।
পাখিদের গান কোনদিনও রেকর্ড হয় না, কেউ রেকর্ডও করেনা। তাদের গানের রেকর্ড হয় শুধু দু জায়গায়– পৃথিবীর বাগানে এবং আকাশের গায়ে।

এই পাখির গানও রেকর্ড হয়েছিল ভয়েজ মাস্টারে। আসলে তাঁর গান যান্ত্রিকতার অনেক আগেই রেকর্ড হয়ে গিয়েছিল আসল ‘হিজ মাস্টারদের’ সরাসরি মুখোমুখি শ্রবণে ও কন্ঠে!

শহীদ নগরের শ্যামসুন্দর দাস। ঘুঙুরগুচ্ছ বুঝি এখনো পায়ের কাছে পড়ে আছে! নেচে নেচে গান, গাইতে গাইতে নাচ সঙ্গে মুদ্রা বিভঙ্গ সে এক মুগ্ধকর দৃশ্য! গোলগাল মুখ বাবরি চুল, কী মনোরম অবয়ব গো!

বাড়িতে কীর্তন দেবে, শ্রদ্ধা জনিত আসর হবে, পালাগান গাইবে কে? শ্যামসুন্দর দাস। কে রেখেছিল গো তোমার নাম শ্যামসুন্দর? শুধু শ্যামে পোষায়নি বুঝি? অতিরিক্ত সংযোগ করতে হলো সুন্দর। তুমি কার দাস গো? ঈশ্বরের দাস না মানবের দাস?
এতো মহাকাব্যিক ঘটনা কি করে মনে রাখো গো? তুমি তো রূপদক্ষ শিল্পী! কখনো সীতা, কখনো বিষ্ণুপ্রিয়া, কখনো কর্ণ, কখনো কখনো অর্জুন কখনো কুম্ভকর্ণ!

শ্যামসুন্দর দা বলে,তুমি তো সুন্দর কথা বলো! তা কি জন্য এসেছো বলো ?

আমি বলি, বাবা তো চলে গেছে।
সে বলে, মাস্টারমশাই চলে গেলেন?
আমি বলি, তার শেষ কাজ। রাতে পালাগান হবে। বেশ লোকজন হবে। গান যেন খুব ভালো হয়।

শ্যামসুন্দর দা বলে, তা কি পালা চাও? আমি বলি কর্ণবধ আর ভীষ্মের শরশয্যা।
সে বলে, নিমাই সন্ন্যাস, সীতার বনবাস হবে না?
আমি বলি,সেটা তোমার ইচ্ছা। যদি একটা ফাউ দাও তো দেবে! শুরু তো গান দিয়েই হবে, গৌরচন্দ্রিকা হবে তো?
সে বলে,হবে, সব হবে।

আমার শ্বশুর বাড়িতে বার্ষিক পালাগান মানেই শ্যামসুন্দর দা। আমার বাবা মা বড় দিদি মারা যাবার পরও কীর্তন পালাগান পরিবেশন করেছে শ্যামসুন্দর দা।

তুমি তো ঈশ্বর ভজনা করো না। তো এসব বায়না করতে দেখি তুমি তো নিজেই আসো!

আমি বলি, এর সঙ্গে তোমার ভগবান ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। মা বাপ মরলো পুরাতনী গান কীর্তন মহাকাব্যিক পালা শুনতে ইচ্ছে হলো। বই না পড়ে অনেক কিছু তোমার কাছ থেকে তোমার মধুর কন্ঠে শুনে কিছু তো শেখা হলো। একে বলে দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে শেখা। আমরা লোকগান ভাটিয়ালি এসব তো শুনি। আমরা গল্প উপন্যাস পড়ি। এতো লোক জীবনের ধারা, এ তো আমাদের নিজস্ব ঘরোয়া জীবনের সংস্কৃতি, শিল্পের ধারার এক চিরবহমান সুরেলা ঐতিহ্য। এর সঙ্গে তো কোনো ভগবান ঈশ্বরের সম্পর্ক নেই যে দাদা! সংস্কৃতির ঐশ্বর্যই যে আমার ঈশ্বর।

পাশের বাড়িতে স্বস্ত্যয়নে গাইতে এসেছে শ্যামসুন্দরদা। তো এখানে তোমাদের বাড়ির ওই উল্টোদিকে তমাল থাকে তো! তাকে বলোনি পালাগান শুনতে আসতে?

ওরা বলে, উনি তো আমাদের মামা। মামিমা এসেছে, মামাতো আসবেই।

আমি রাত সাড়ে আটটা নাগাদ পালাগান শুনতে যাই। গিয়ে তাঁকে প্রণাম করি। তিনি আমার থুতনিতে হাত দিয়ে সেই হাতটা নিজের ঠোঁটে লাগিয়ে চুমু খান।

আসর শেষে তার পাশে বসে আড্ডা দিই। বলি , মৃত্যুর মতো সুন্দর কিছু হয় না বলো গো দাদা!
সে একটু হকচকিয়ে বলে, কেন?
আমি বলি, মৃত্যু না হলে কি করে তুমি পালাগান গাইতে, ঘুঙুরে ছন্দ তুলতে, মৃদঙ্গ খোল হারমোনিয়াম বেজে উঠত, তোমার মন্দ্রকণ্ঠে বিষ্ণুপ্রিয়া গো, আমি চলে যাই…. আর আমরা আবেশে চোখের জল ফেলে অন্য লোকে চলে যেতাম!

শ্যামসুন্দর তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে।

বুধবার ভালো দিন গো! বুধ মানে তো প্রজ্ঞা।
তোমার কণ্ঠ ভেসে যায়…
হুঁশিয়ার! মন মাঝিরে সাবধানে যাও রে নাও বাইয়া…
ওরে দরদিয়া তোমারও লাগিয়া কলঙ্কিনী হলাম রে!