শিশু দিবসঃ অবতকের বিশেষ প্রতিবেদন
শিশু সম্বন্ধে এর বেশি আমি জানিনা
তমাল সাহা
ঘুম থেকে উঠে একটু হাঁটতে বের হই। হেমন্তকাল সকালে হাঁটতে হাঁটতে দেখি মাথা একটু ভিজে ভিজে। মাথার কি দোষ? ওস পড়েছে। ওস শব্দটি খুব নরম শব্দ। এ শব্দটি সকলেই জানে। গাছের পাতারাও ঝরতে শুরু করেছে।
বেরিয়েই দেখি শিশু। পথের ওই দিকে কবরস্থান ময়দান। এপাশে এক কোণে পৌরসভার ময়লা তোলার বিশাল গাড়ি। দেখি দুটি শিশু ময়লা গাড়িতে উঠে কি খুঁজছে। সকাল থেকেই অনুসন্ধান চলে। বোধ করি জীবন সন্ধান। শিশু দুটি থলেতে ঐশ্বর্য কুড়িয়ে ভরতে থাকে।
শিশু শব্দটি হঠাৎ অভিঘাত সৃষ্টি করে। এতে শিস ধ্বনির প্রাধান্য দেখি। এ শিশু দুটি কিশোর। শিশু কিশোররা গাল চেপে দুটো ঠোঁট ছোট করে যেমন, তেমনি মুখে ডান হাতের তর্জনী এবং বুড়ো আঙুল ঢুকিয়ে শিস দিতে শিখে যায়।এই দ্বিতীয় প্রকার শিস যে শিশু-কিশোর দিতে জানে আমরা বলি, ও একটু পাকা হয়ে গিয়েছে। এই শিসে শ্বাসের জোর থাকে, ধ্বনির তীব্রতা থাকে।
হাঁটতে থাকি। অসংখ্য শিশু বেরিয়ে পড়ে রাস্তার ধার থেকে, সূর্যসেন ক্ষুদিরাম নিরঞ্জন সেন কলোনি থেকে। কলোনির নাম এদের নাম কেন, চোখে একটু বিদ্যুৎ খেলে যায়। আমাদের এখানে শরৎ কলোনি, রামকৃষ্ণ কলোনিও আছে। ধরমবীর কলোনি আছে খালধারে।
শিশুদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নজরুল সুকান্ত বীরেন চট্টোপাধ্যায় নীরেন চক্রবর্তী অন্নদাশঙ্কর রায় সুকুমার রায় মণিভূষণ ভট্টাচার্য আরো অনেকের লেখা পড়েছি। এখন রাস্তায় বেরিয়ে দেখি শিশুরা বড়ই হয়নি। জহরলাল নেহেরুর জন্মদিবস বা আন্তর্জাতিক শিশু দিবসের বয়স বাড়লেও শিশুদের বয়স বাড়ে না। তারা আদি অকৃত্রিম ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলে। এস ওয়াজেদ আলী একটি বাক্যেই সমগ্র ভারতবর্ষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বাক্যটি বোধ করি এমনই হবে, সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে,কোথাও তার পরিবর্তন হয় নি। শিশু, হ্যারিকেনের নিভু নিভু আলো, রামায়ণ– এক বাঙ্ময় চিত্র চিত্র।
হেমন্তে চাঁদের আলো পড়েছে ফুটপাতে। মা ইটের উনুনে ধূম কালিপরা ছোট হাঁড়িতে ভাত ফোটাচ্ছে। হৈমন্তী হাওয়ার ভেতর ভাত-জলের ফ্যানাগন্ধী বাষ্প উড়ে যায়।উনুনের পাশে শিশুটি গালে হাত দিয়ে ভাত ফোটার দৃশ্য দেখে। চিত্রময় হয়ে ওঠে ফুটপাত।
গর্ভবতী ভিখারিণী কোন মতে একটা পাতলা শাড়ি জড়ানো গায়ে শুয়ে আছে প্লাটফর্মের ওই কোণে। পেটে নেই ভাত অথচ পেটটি ভরাট–পোয়াতি শরীর। পাশে বছরবিয়োনি শিশু ঘুমন্ত মায়ের জীবন্ত মাই
চুষছে। এ দৃশ্য যে দেখেনি সে এই ধরিত্রীতে মাতৃগর্ভে জন্মায়নি!
হাঁটতে থাকি চাঁদমারি রোড ধরে সাজানো শহর কল্যাণীর দিকে। চাঁদমারি শব্দটি একটু তোলপাড় তুললো নাকি! এই রাস্তার দু’পাশে শিশু দেখি। এতো শিশু থাকে কোথায়? চাঁদমারি রোডের দিকটা একটু গ্রামীণ। গাছপালা আছে রাস্তার দুপাশে। বড় বড় গাছ আকাশের মাথা ছুঁয়ে থাকে। একটি শিশু মাথা উঁচু করে গাছের দিকে তাকায়। ভাবে গাছ এত উঁচু হতে পারে! মানুষরা কেন পারে না? ওরা দু’পাশে ঝরাপাতা, শুকনো ডালপালা কুড়োয়।
হাইওয়েতে উঠে পড়ি। এক পাশে বিশাল ডাম্পিং গ্রাউন্ড। দেখি ডাঁই করা আবর্জনা স্তূপে শিশুদের চলাচল। দেখি ওদের দৃষ্টির তীব্রতা। সব শিশুই এতো ছোট কিন্তু কাঁধে এতো বড় ঝোলা! শিশু নয় মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে আসে, অনেকে জন্মদাতা বাপের পরিচয় হয়তো জানে না কিন্তু এত বড় বড় ঝোলা সে কোথায় পায়? শিশুরা দেখি কাগজ, পলিথিন ব্যাগ, বোতল, টুকরো টাকরা লোহা ভরে নেয় ঝোলায়।
ভাগীরথী পারে যাই, শিশু দেখি। সেখানে সে নদী পার থেকে প্রতিমার কাঠামো তুলে নেয়। নটবর ঘাট শ্মশানে যাই। দেখি শিশু মড়ার লেপ তোষক বালিশ সংগ্রহ করে।
পাহাড়ে যাই, সেখানেও শিশু। এতো উঁচুতে শিশুরা উঠে কি করে? পাহাড় তো পর্যটন কেন্দ্র। রেস্তোরাঁর বাইরে শিশুরা মদের বোতল সংগ্রহ করে। দার্জিলিংয়ের পাহাড় দেখবে, কাঞ্চনজঙ্ঘার সূর্যোদয় দেখনেওয়ালা বাবু ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে শিশুটিকে দেখে বাঁকে, এই এদিকে আয়, এ বোতল দুটো নিয়ে যা!
সমুদ্র পারেও শিশু। সেখানে তারা শামুক ঝিনুক সংগ্রহ করে আর সমুদ্রের ঢেউগোনা বিলাসী বাবু-বিবিদের বিক্রি করে। দুনিয়া শিশুময়। শহরের চায়ের দোকান, বিরিয়ানির দোকান, রেস্তোরাঁ চারিদিকে শিশু। সোনার দোকান, বারুদের কারখানায় শিশু।
হায়! মহাভারতীয় অমৃত অধ্যায়। সূর্যের ঔরসজাত কানীন শিশুপুত্র কর্ণকে কুন্তী ভাসিয়ে দিয়েছিল নদী জলে।
শিশুরা কি পারে আমি জানিনা, সে সব কবিরা জানে।
শিশুরা ভোলানাথ হতে পারে, শিশুরা লিচু চোর হতে পারে, শিশুরা বোধ করি বীরপুরুষও হতে পারে, এমন কি শিশুরা চাঁদ দেখতেও জানে— বাঁশ বাগানে মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই…
ভিখারি মায়ের শিশু কলকাতার যীশু যান স্তব্ধ করে দিতে পারে। শিশুই একমাত্র জিজ্ঞেস করতে পারে, রাজা! তোর কাপড় কোথায়? আর সক্রোধে বলতে পারে, ভাত দে হারামজাদি!









