রাতের গদ্য
তমাল সাহা
সূর্যটি পশ্চিম আকাশে
ঝুলতে ঝুলতে হঠাৎ ডুবে গেল।
নদী পারে দাঁড়িয়ে থাকা
শহরের আলোগুলো জ্বলে উঠলো।
আকাশের গায়ে নক্ষত্র ফুটলো কিন্তু
চাঁদ একটু মেঘের আড়ালে।
ওপারে ডানলপ ফ্যাক্টারির চিমনিটাকে
কবন্ধ কণিষ্কের মতো দেখাচ্ছে।
কারখানা দীর্ঘ বছর বন্ধ।
ভাগীরথীর মাঝে বিশাল চরা।
তার ধার ঘেঁষে লঞ্চটি চলে গেল।
একটা মরা গরু ভেসে যাচ্ছে।
রামপ্রসাদ ঘাটে এলোমেলো মাস্ক মুখে
ক’টা ভিখিরি শুয়ে আছে।
ভিক্ষে তেমন জোটেনি।
বালিভাড়া অঞ্চলে যশের (ইয়াস) মারাত্মক ক্ষতচিহ্নগুলি থেকে রক্ত ঝরছে। ঝোড়ো সৌন্দর্য দেখতে বেরিয়ে পড়েছেন নেতাগোছের মানুষজন, সঙ্গে স্যাঙ্গাত। দূরে ঘেসুরে আদিবাসী নারীরা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। চক্ষুনদীতে জল। শুয়ে থাকা লাশের মতো পড়ে আছে ঘরের চালা।একে অনেকে বলে আশ্রয়, শান্তিনীড় বা মঞ্জিল!
নটবর ঘাটে একটা কোভিড লাশ দাহ হচ্ছে.
নটবর ঘাটের সামনে লেখা আছে– মহাশ্মশান।
শ্মশানের আগে মহা শব্দটি বসানো কেন! মৃত্যূর অনিবার্যতা বোঝাতে বোধ হয়।
আরেকটি মৃতদেহ অপেক্ষা করছে।
মহাজীবন কথাটি কোথায় লেখা থাকে?
মৃত্যু ও জীবনের চলমানতা একসঙ্গে চলছে।
লকডাউন!
রাস্তাঘাট শুনশান।মানুষ নিশ্চুপ, গৃহবন্দী।
জানালা এখন তার বন্ধু।
বাতায়ন মানুষের জীবনে বিশাল গুরুত্ব পেয়েছে।
শুধু শাসক কথা বলছে
নিজের ইচ্ছেমতো টিভিতে।
লকডাউনের দিন আরও বেড়ে গেল।
কি কি করতে হবে– শাসক বলছে।
কোভিডে আক্রান্ত বা মৃত্যুর সংখ্যা বলছে না। কত হাসপাতাল, কত বেড–তাও বলছে না। মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে বললে কি জীবনের সংখ্যা বাড়ে?
পরিযায়ী শ্রমিক বা দিনমজুরদের রোজকার উপার্জন বন্ধ।
তাদের দিন রুজির কি হবে,সে কথাও কেউ বলছে না। এন আর সি চাই না, গেরুয়াকে ভোট নয়– না বাচক বাক্য দুটি মানুষের খুব পছন্দ হয়েছিল। এখন কেউ শোরগোল তুলছে না, হ্যাঁ-বাচক বাক্যে বলছে না— দিনমজুরদের দৈনিক রুজি চাই। ভোটের পর পরই একের পর এক বন্ধ জুট মিল গঙ্গাপার জুড়ে ভৌতিক পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে।
এইমাত্র খবর এলো এন্ড্রয়েড মোবাইলের
হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টুইটার সমস্ত কিছু
চলে গেল শাসকের দখলদারিতে– ব্যক্তিগত বলে আর কিছুই থাকছে না।
চুম্বন শব্দটি রাষ্ট্রীয় দখলে চলে যাচ্ছ। বিষচুম্বন, না প্রেমচুম্বন এবং কার উদ্দেশে এ নিয়ে ছানবিন হবে। লেখককে শমন পাঠাবে শাসক।
হিটলার গোয়েবলসকে নিয়ে হাঁটছে বার্লিনের রাস্তায়।
বুটের খটাখট শব্দ শোনা যায়…
মৃত্যু এখন অনেক স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
মারা যাবার পর মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে।
জীবন থাকতে জীবনের সংবাদ নেই।
ঝুঁকি নিয়ে কারা যেন
অম্লজান সিলিন্ডার নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।
এদের মানসিক রোগী বলে মনে হয়।
এরা জীবন! জীবন! বলে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
যত দূর মনে পড়ে বঙ্কিমচন্দ্র এমনই লিখেছিলেন—
পরের জন্য কাষ্ঠ সংগ্রহের স্বভাব যার সে কাষ্ঠ সংগ্রহে যাইবেই।তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন?
বঙ্কিমচন্দ্রের নবকুমার আর শরৎচন্দ্রের ইন্দ্রনাথ এমন কয়েকজনকে দেখে রাতের গদ্যটার মন ভালো হয়ে গেল।
আলোকচিত্রঃ স্বপন গাঙ্গুলি।