এই জনপদের কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য একদিন সময়ের রেডবুক ‘গান্ধীনগরে রাত্রি’ কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেনৃ
উত্তাল সত্তর দশকে তিনি ছিলেন একজন অন্যতম কবি।
কাঁচরাপাড়া হারনেট হাইস্কুলে শিক্ষক হিসাবে তার কর্মজীবন শুরু‌। তিনি ছিলেন নৈহাটির অধিবাসী।
আজকের দিন ১৩ জানুয়ারি তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন

মণিভূষণ ভট্টাচার্যঃ তোমাকে খোলা চিঠি
তমাল সাহা

তুমি কি জানো
এখনো মন্টুরা বেঁচে আছে!
নির্ঝর স্বপ্নভঙ্গ চোখে ঘুম থেকে ওঠে–
বেকারের চিঠি পড়ে থাকে।
দেশ বিক্রি হয়ে গেছে কোন্ ফাঁকে!

এবার প্যাঁদাবো হারামি ওসি-কে
খিস্তি মেরে বলেছিলে,শালা!
প্যাঁদাবে কি করে?
ওসি-তো এখন শাসক দলের চ্যালা।

সেসব দিন চলে গেছে কোন খেয়ালে
‘বন্দুকের নলই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস’
কেউ লেখে না আর ভুসোকালিতে দেয়ালে।
‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো’
সেসব ডানপিটেরা কোথায়?
দলবাজির কার্ফু এখন ঢুকে গেছে
যুবকদের মাথায়।

‘কৃষি বিপ্লব ত্বরান্বিত করুন’
কোথায় কৃষক? কৃষক তো ডুবে দেনায়!
কীটনাশক খেয়ে মেতে ওঠে আত্মহত্যায়।

বিপ্লব মগজ থেকে উড়ে গেছে
এখন সাইনবোর্ডে লেনিন মাও চে।
শুধু দিন কাটাও তত্ত্ব-ভাষণ-বুকনি বেচে।

এনকাউন্টারে—
কত লাশ পড়েছিল বরানগর বেলেঘাটা
কাশীপুর কোন্নগরে!
এখন বিপ্লবীরা খণ্ড-খণ্ড অনন্ত
জনগণ বিভ্রান্ত, দিগভ্রান্ত—
আসল কাজ ছেড়ে
তারা এ ওর আদর্শহীনতা খুঁজে ফেরে।

ধর্ষিতা মেয়েটি পড়ে আছে সেই কবে থেকে দেখেছিলে তুমি উৎকণ্ঠ শর্বরী।
রাজনীতির ছন্দ মাত্রা ঠিক রেখে
স্করপিও গাড়ি
কবিবর চলে যান শাসকের বাড়ি।

পান্ধীনগরে আবার রাত্রি নামে
তাতে কার কি আসে যায়!
ধর্মের গেরুয়া স্রোতে
রামধুন গাইতে গাইতে জীবন চলে যায়।

দুঃখ এখন আমার শোক হয়ে ঝরে
ভারতবর্ষ দেখি আর নির্বোধ ভাবে তাকিয়ে থাকি
অস্ত্র নেই হাতে, শব্দ নিয়ে হাত শুধু নিশপিশ করে!

পার্লামেন্ট শুয়োরের খোঁয়াড় সাংসদরা তাড়া খেয়ে পার্লামেন্টের বাইরে স্বছন্দে ঘোরে ।
বিলকিস বানুকে এগারো বার ধর্ষণ করে হাজার হাজার দুঃশাসন নতুন ভারত গড়ে।

রাষ্ট্র এখন ভারতবর্ষ জুড়ে মহাধর্মযাত্রা- মন্দিরপ্রতিষ্ঠা নিয়ে মহাঅভিযান করে।
জনকোষাগার ফাঁকা, প্রজন্মকে পথে বসিয়ে জগন্নাথ মন্দির গড়ে ওঠে দীঘার সমুদ্র কিনারে
শ্রীরাম মন্দির নির্মাণ হয় অযোধ্যা নগরীর সরযুর তীরে।

ভেবেছিলাম তোমার সঙ্গে একসঙ্গে যাবো, ঐতিহ্যবাহী শ্রীরামকে দর্শন করবো
আমি হব পর্যটক গাইড বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলবো তোমাকে মন্দিরের বিবরণ।
এখন কোথায় তুমি আছো জানিনা তবে শোনো
আমার প্রবীণ প্রিয় প্রাজ্ঞজন!
আমাদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে তিন তলা মন্দির। দ্যাখো দৈর্ঘ্য ৩৮০ ফুট প্রস্থ ২৫০ উচ্চতায় ১৬১ফুট।
নারী সুরক্ষা বিল পাস হয়ে গেছে তবুও নারীর ইজ্জতা হয়ে যায় লুট
মন্দিরের নিরাপত্তায় তাকে ঘিরে আছে শত শত লোহার নাল লাগানো বুট।

দর্শন করো,প্রথম তলে গর্ভগৃহ-শ্রীরাম প্রাঙ্গণ
কত শিল্পিত কারুকাজ, কত দেবদেবী মার্বেল পাথরে মোড়া কীবা অনুপম!
গর্ভগৃহে বিগ্রহ বালক শ্রীরাম– ওরা বলে রামলালা।
আমি বুঝিনা এখানেও সেই লালের সংকেত কেন, লাল থেকে বোধ করি লালা!

এই দেখো নৃত্য মণ্ডপ রঙ্গমণ্ডপ গূঢ় মণ্ডপ প্রার্থনা মণ্ডপ কীর্তন মণ্ডপ
মন্দিরের চত্বরে দেখো আরো চারটি মন্দির
সূর্য শঙ্কর গণপতি ভগবতী
মুনি বাল্মিকী বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্র অগস্ত্য গুহক শবরী অহল্যাও পাবে আরতি।
উত্তরে দেখো অন্নপূর্ণা মাতা দক্ষিণ দেখো হনুমান।
হায়! মর্ত্য চোখে দেখিতে পারিলে না তুমি তার আগেই হয়ে গিয়েছে প্রয়াণ!

কেন্দ্র না রাজ্য কে আবাসন প্রকল্পের টাকা মেরে দিয়েছিল আমি কি তার জানি
এতদিন রাম কোথায় ছিল? আশ্রয়হীন হয়ে অনাথ ঘুরে বেড়ায়
এখন নিশ্চিত একটি মাথাগোঁজার ঠাঁই পেয়ে গিয়েছে রাষ্ট্রীয় দয়ায়।

আমিও এখন ঘনঘন ফেট্টি বাঁধি রামধুন গাই।
এই মর্ত্যলোকে কত করেছি পাপ
ধর্মের গান না করলে কিভাবে বেলাশেষে স্বর্গে পৌঁছাই!
যতদিন থাকি যতদিন বাঁচি শাসকের সঙ্গে মিলিয়ে হাত করে যাই কামাই।

লড়াকু মাতঙ্গিনী,লাঠিহাতে গান্ধী দাঁড়িয়ে শুধু দেখে
রুটি নেই রুজি নেই প্রজন্ম বসে আছে পথে মুখ ফ্যাকাসে
চন্দ্রযান পৌঁছে গেছে চন্দ্রলোকে, লাথি মেরে ওই মহাকাশে!

তাই এখন আবার তোমার কবিতা মন্টুর জীবন পড়ি
পাউন্ড পাউন্ড পাউরুটি পিস করেও
মন্টুর হাতে ছিল একখানা ধারালো ছুরি।
সেই ছুরি ধরতেও এখন হাত কাঁপে
জীবন আমাদের গিয়াছে কোথায়—
হায়! শুধু জোচ্চুরি।