আজ সংবাদপত্র স্বাধীনতা দিবস

ভালোবাসার কলম-ক‍্যামেরা
তমাল সাহা

ভালোবাসা কি তবে পাপ?
তোমাকে ভালোবাসি- এই উচ্চারণই তো
আমার মহাঅপরাধ।

তোমার শরীর জুড়ে এই
ভালোবাসার বিচ্ছুরণ, ঐশ্বর্য।
তোমাকে কলুষিত করতে চাইবে কেউ
আমার চোখের সামনে,
এ আমি ভাবতেও পারি না।
আমি যে তোমাকে বড় ভালোবাসি।

তোমার বুকের উপর সুন্দর সাজানো উদ্ভিদগুলি,
ওরা পর পর কেটে নিয়ে চলে গেল।
জমি বেচে দিল বেচারামেরা।
তোমার ওই স্বচ্ছ দিঘির জলে আমার মায়েরা আর ছটপুজো করতে পারবে না।
বিয়ের মঙ্গল উৎসবে এয়োতিরা আর কলসি কাঁখে জল ভরতে যাবে না।
মাঘি পূর্ণিমায় পুণ্যব্রত হবেনা।
হাঁটু জলে নেমে ওরা পদ্ম দিঘিতে ভাসাতে পারবে না ঘিয়ের প্রদীপ।
ওরা তোমাকে ভরাট করে দিচ্ছিল আমার চোখের সামনে।
এ আমি সহ্য করতে পারিনি।
আমি যে তোমাকে বড় ভালোবাসি।

আমার অপরাধ–
দুটি অস্ত্রের ব্যবহার আমি করেছিলাম।
গোপন অস্ত্র দুটির কথা এখন আমার আর খোলসা করে বলতে দ্বিধা নেই।
একটি হল ক-এ ক্যামেরা,
অন্যটি হল ক-এ কলম।
আমি ওদের অন্যায়গুলির চলমান ছবি লেন্সবন্দি করছিলাম আর
আমার প্রিয় বর্ণমালায়
আক্ষরিক রূপ দিয়ে প্রকাশ করছিলাম
সংবাদপত্রের পাতায়।
আমার অপরাধ,
আমি যে তোমাকে খুবই ভালবাসি।

ওরা আমাকে মারল,
প-এ পুলিশ প্রশাসনের চৌহদ্দির মধ্যে
ওরা আমার নাক মুখ ফাটিয়ে দিল,
প-এ পার্টি দপ্তরের সামনে,
নেতা-নেত্রীদের সতর্ক ইশারায়।
আমি আড়চোখে নেতানেত্রীদের দেখছিলাম।
আমার গলা বেয়ে থুতু উঠে আসছিল উপরের দিকে।
কিন্তু আমি গিলে ফেলেছিলাম।
কারণ,নেতা নেত্রীর কথা মনে হতেইআমার চোখে ভেসে উঠছিল গান্ধিজি, নেতাজি,ভগৎসিং,মাতঙ্গিনী,প্রীতিলতা মায়ের মুখ।
আমি ভাবলাম
নেতা নেত্রী শব্দ দুটির কি দোষ?
আমি মার খেয়েছিলাম বেদম।
আমি মরেই যেতাম,
তোমাকে ভালোবাসার কোন খাদ,কোন খুঁত ছিল না আমার মধ্যে।
তাই আমি বেঁচে গিয়েছি।

ওরা আমাকে মারল
এক ঐতিহাসিক জায়গায়,
যে জায়গাটির দোতলায় আমার দাদিমা থাকতেন
আর ফি বছর জয়হিন্দ, বন্দেমাতরম ধ্বনি, দেশাত্মবোধক গান শুনলেই কানে হাত দিয়ে এদিক ওদিক ঘরের মধ্যে পায়চারি করতেন।
দেশাত্মবোধক গানকে তিনি ভয় পেতেন।
কারণ সেদিন তিনি থানামোড়ে দাঙ্গা আর হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
প্রথম স্বাধীনতা দিবস!
রক্তে ভেসে যায় দেশ? দেশাত্মবোধক গান শুনলেই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিপন্ন অসহায় মুখ।
তিনি শুনতে পেতেন তাদের আর্তনাদ।
আক্রান্ত সেই দাদিমার নাতি আমি।
দাদিমা দেখো, সেই দাঙ্গাবাজরা স্বাধীন দেশে আজ অন্যরূপ নিয়েছে।
আমি বেঁচে গেছি দাদিমা,
আমি যে তোমাকে বড়ই ভালোবাসি।

দাদিমা!আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি
তখনও দাঙ্গাবাজদের পেছনে ছিল
রাজনৈতিক মদত,
এখনো লুম্পেনদের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক উস্কানি।

আমি ভয় পাইনি,ওরা ভয় পেয়েছে,
শুধু ভয় নয় ভয়ঙ্কর ভয় পেয়েছে।
তাই তো ওরা আমাকে রক্তাক্ত করেছে।
আসলে ওরা ভয় পেয়েছে
দুনিয়ার সবচেয়ে দুটি বৃহত্তম, মহত্তম আবিষ্কার —
কলম ও ক্যামেরাকে।

ওই অস্ত্র দুটির অধিকার কোন রাষ্ট্রের নেই।
কোন রাষ্ট্রীয় মস্তানের নেই।
তাতে আমাদের একমাত্র অধিকার।
রাষ্ট্র অস্ত্রাগার বানায়।
ক্যামেরা,কলম বানানোর ক্ষমতা তাদের নেই।
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে
আমাদের ক্যামেরা ঝলসে ওঠে।
দুর্বার গতিতে আমাদের কলম শানায়।
রাষ্ট্র রাষ্ট্রীয় মস্তান অস্ত্রবাজ–
ওরা শুধু হত‍্যালিপি লিখতে জানে।

আমাদের অস্ত্র আমাদের নিজস্ব।
আমরা ক্যামেরা ঝলসাতেই থাকব‌।
আমরা কলম শানাতেই থাকব।
কলম-ক‍্যামেরা দিয়ে
আমরা লিখে যাবো
জীবনের কবিতা ভালোবাসার কবিতা