বীজপুর নাট্যোৎসব- হালিশহর লোকসংস্কৃতি ভবন

অবতক-এর বিশেষ প্রতিবেদন

অমিতাক্ষরঃ একটি সামাজিক দায় ও দায়বদ্ধতার নাটক 

অবতক খবর,১৯ জুনঃ একটি নাটক কি দিতে পারে? একটি নাটক কি করতে পারে? নাটকটি যদি সরব সত্যভাষ্য হয়ে ওঠে গভীরতম অন্ধকারের মধ্যেও দর্শককুল একটি উপশমের বাতাস খুঁজে পায়।

এই ব্যবস্থায় সামাজিক পরিবেশে প্রভাবশালীরা কতদূর যেতে পারে আর তারা যদি ঘোষিত সমাজবিরোধী ও অসাধু ব্যবসায়ী হয় তবে কিভাবে জনজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে– তাদের হাত যে শাসকেরও ঊর্ধ্বে উঠে যায়, আর এই হাত যে কত লম্বমান তা প্রদর্শন করতে পারে তার পোস্টমর্টেম করে এই নাটক। সামাজিক বীক্ষণ এই নাটক টেলিস্কোপ নয় মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখায়।

স্বাধীনতার জন্য বিপ্লবী ও জেল খাটার সার্টিফিকেট থাকলেই যখন তাম্রপত্র ও ৫০০ টাকা মাসিক পেনশন পাওয়া সহজলভ্য, তা বুঝিয়ে দিতে স্পর্ধা দেখায় মঞ্চের কুশীলবেরা। ভুয়ো বিপ্লবী সেজে এই অর্থ উপার্জন যে একটি সহজ পণ্য তা দেখায় নাটক। কোন পথে কিভাবে গেলে কাদের সহযোগিতায় এই সম্মান ও স্বীকৃতি পাওয়া যায় তা বলে এই নাটক। ফলত, বর্তমান সময়ের দুর্নীতিগ্রস্ত একটি ব্যবস্থার প্রতি দর্শক বা শ্রোতৃবৃন্দ সচেতন হয়ে ওঠেন। তবে আর্থিক দুর্যোগে গেরস্থালি জীবনে এই অসম্মানীয় সম্মান ও তাম্রপত্র গ্রহণে মূল চরিত্র অভিনেতার বিন্দুমাত্র আপত্তি থাকে না। মধ্যবিত্ত আত্মধিক্কার একটা অপমানকে সে কিন্তু হৃদয়ে জাগরুক রাখে। একটু বেঁচে থাকার জন্য অর্থ উপার্জনের এই পদ্ধতির জন্য গেরস্থালি পরিবেশও তাকে প্রায় বাধ্য করে তোলে। তার সহযোদ্ধা স্ত্রী এবং প্রিয় প্রজন্ম পুত্রও একটু অপরাধ করা যায় এই আর্থিক বিপন্নতায় তাতে প্রায় সমর্থনই জোগায়।

অপকর্মের আগে সাংস্কৃতিক শব্দটি যুক্ত করে চাঁদা তোলার নামে প্রতিবেশীদের উপর জুলুমবাজি, কামাইবাজি প্রক্রিয়া যে চলমান স্বীকৃতি তা প্রকট করে তুলেছে এই নাটক। এমনকি ৫০০ টাকা পেনশনভোগী বিপ্লবীরও সাংস্কৃতিক চাঁদা ৫০১ টাকা ধার্য করা হয়। স্বাধীনতা ব্যর্থ। বিপ্লবীদের আত্মবিসর্জন ব্যর্থ। সর্বজনীনভাবে তা প্রকাশ করতে প্রকৃত বিপ্লবী হতে শেষপর্যন্ত দায়বদ্ধ হয়ে পড়েন ভুয়া বিপ্লবী সাজা মানুষটি। তিনি উপলব্ধি করেন এইভাবে দিনের পর দিন মাসের পর মাস রাষ্ট্রীয় মুদ্রা অর্জন তার পক্ষে যন্ত্রণাদায়ক।

স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ না করলেও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, আত্মবলিদানের ঘটনা, কিশোর ক্ষুদিরামের ফাঁসির দড়ি, বিপ্লবী সতীশ হাজরার উপর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অত্যাচার-নির্যাতন–হাত পা ভেঙে দেওয়া, দাঁত উপড়ানো, জিভ কেটে দেওয়া,আর তার প্রতিক্রিয়ায় ম্যাজিস্ট্রেটকে সতীশ হাজারর বৃদ্ধ পিতার হত্যার প্রচেষ্টা,এই আখ্যান পাঠে ভুয়ো বিপ্লবী হয়ে পড়েন নতুন ধারার বিপ্লবী।

নাটকে বেকারত্বের জীবন, নারীদের অসম্মান, সম্মানীয় বিপ্লবীকে পণ্য করে সোনা চাঁদির দোকান উদ্বোধন, পাড়ার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হওয়ার আবেদন-আমন্ত্রণ বর্তমান সময়কে কি ছুঁয়ে যেতে চায়?

নাটকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের দেশাত্মবোধক গানের চেতনার সংযোজন অন্য মাত্রা এনে দেয়। তবে শাসক ও রাজনৈতিক দলের বিষয়টি কেন নাটকে অনুপস্থিত এ প্রশ্ন জাগে। যে দুর্বৃত্তায়ণ নাটকে প্রকট হয়ে ওঠে এ তো রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ! তা শাসকশ্রেণীর ছত্রচ্ছায়া ও মদত ছাড়া কিভাবে সংঘটিত হতে পারে?

মনতুষ্টির পুরস্কারের জন্য নয় প্রতিটি চরিত্রই নাটক মঞ্চায়নে ‘দুর্দান্ত’ অভিনয় করেছেন।কুশীলবদের যৌথ বলিষ্ঠ কর্মকুশলতার ফসল এই নাটক– এটা স্বীকার্যে এই আলোচকের দ্বিধা নেই।

নারী চরিত্রে নীহার দেবী ও মেয়ের ভূমিকায় রিঙ্কু বাস্তব অভিনয় করেছেন। উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন মুখ্য চরিত্র শঙ্কর প্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এটা অনস্বীকার্য এই নাটকের মূল অভিনেতা তার স্বর প্রক্ষেপণ ও শারীরিক বিভঙ্গে প্রতিমুহূর্তে শ্রোতাদের সচেতন করেছে, শ্রোতারা রুদ্ধনিঃশ্বাসে তা শুনেছেন তো বটেই, তাদের উজ্জীবনও ঘটিয়েছেন।

এই নাটক মঞ্চ আলো আবহের নির্মাণে শিল্পীত কারিগরি প্রদর্শনের উপযোগী ভূমিকা পালন করেছেন নির্মাতারা। নির্দেশক তুতুন লাহিড়ীকে কুর্নিশ।

নাটক কি দিয়েছে? এক কথায় সামাজিক দায় ও দায়বদ্ধতার পরিচয়।

নাটক অমিতাক্ষর

রচনা দেবাশিস মজুমদার

প্রযোজনা চরিত্রায়ন

নির্দেশনা তুতুন লাহিড়ী

মঞ্চ আকাশ ভৌমিক

আবহ সুজয় সেনগুপ্ত

আলো মনোজ প্রসাদ