আমাদের ভাটপাড়া হতে পারতো দক্ষিণেশ্বর কিন্তু কেন হলো না? ৩১ মে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবস।
মা রে তোরে কে পটাবে? আমার নামে নিন্দা রটাবে?
বীজপুরের সেই মেয়েটি ও একটি মন্দিরের ইতিহাস
তমাল সাহা
বেলা পড়ে এলে পশ্চিম প্রান্তে রৌদ্র হেলে পড়ে। আলোক বৃত্তটি ম্রিয়মাণ হতে শুরু করে আর হাঁটতে থাকে জলের দিকে। পশ্চিমে ভাগীরথী বয়ে যায়। গাছপালা বনানীময় পরিবেশ নিয়ে পুরাতনী আখরগুলি জেগে ওঠে রাণী রাসমণি ঘাটে।
হালিশহরের কোথায় জন্মেছিলি রে মেয়ে তুই, কোনায় না গোলাবাড়িতে? এসব এখনো রহস্যময় হয়ে আছে বুঝি! সেটা কোনো বড় কথা নয়।
তুই তো হালিশহরের মেয়েই ছিলি। লেখাপড়া জানা নেই, কোন ঘরেরই বা মেয়ে তুই, চাষাকৈবর্তের ঘরের না ধীবরের মেয়ে? আমি এখনো জানি না কিছুই। আর জানারই বা কী দরকার! মানুষ মানুষ-ই, এটা ভাবলেই তো চলে। চন্দ্র সূর্য আগুন জলের আবার ধর্ম কি, জাতই বা কি, বর্ণই বা কি?
শুধু ভাবি দক্ষিণে ঈশ্বর থাকে, দক্ষিণ-ই বা কি, ঈশ্বরই বা কি তা তুই বুঝলি কি করে? আরো ভাবি সকলেই তো কাল নিয়ন্ত্রণী দেবীকে কালী বলে সে কি করে হয় ভবতারিণী? ভব কাকে বলে, তারিণীই বা কে, এত সব তুই জানলি কি করে? এইসব শব্দগুলি শিখলি কি করে তুই?
এই পড়ন্ত বেলায় সূর্যের নরম আলো ভাগীরথীর জলে প্রতিফলিত হয়ে নড়েচড়ে। তোর এইসব আখ্যান উপাখ্যান হয়ে দাঁড়ায়।
এ অক্ষরলিপিতে আমি কোনো ধর্মের কাহিনীর প্রচার করতে নামিনি অথবা ধর্মকথা বর্ণনা করতে আসিনি। যে দর্শনীয় স্থাপত্যটি হতে পারতো ভাটপাড়া শ্মশান সংলগ্ন অঞ্চলে তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে এই জনপদের মানুষ, তা জানাতে এসেছি। এই জনপদ কেন বঞ্চিত হল? এ তো সেই সাবেকি ব্রাহ্মণ্যবাদের গল্প। মন্দিরের জন্য জমি তোয়জোগাড় হয়ে গিয়েছিল। রাজি হয়েছিল জমির মালিক জনৈক বলরাম বাবু। রটে গেল গ্রামে গ্রামে চাষা কৈবর্তের মেয়ে তৈরি করবে মন্দির এই চত্বরে, তা আবার হয় নাকি? ভাটপাড়ার গোঁড়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা তো বটেই বিশেষ করে জমিদার গৌরাঙ্গপ্রসাদ, রামরতন দত্তরায়, প্রাণনাথ চৌধুরি বাধা হয়ে দাঁড়ালেন।
জন্মভূমিতে মন্দির স্থাপনের ইচ্ছা প্রশমিত হলেও তা গুমরে গুমরে কেঁদে জেগে উঠতে থাকলো অন্তরে। শেষ পর্যন্ত জমি কিনল সেই মেয়ে কুড়ি একর। সাহেব জন হেস্টিং-এর কাছ থেকে। জায়গাটির নাম ছিল সাহেবান বাগিচা। একটি অংশে ছিল মুসলমান গোরস্থান। জমিটির আকারের সঙ্গে কচ্ছপের পৃষ্ঠদেশের আকারের সাদৃশ্য ছিল। ধর্মজ্ঞদের মতে তন্ত্র সাধনার উপযোগী পীঠ। আমার আশ্চর্য মনে হয় সাহেব তো খ্রিস্টান, আবার এই জমিতে মুসলমানদের কবরভূমি সেখানে তৈরি হলো বিশাল উপাসনালয় শাক্ত মন্দির!? তৈরি হল শ্রমজীবীর হাতে নবরত্ন মন্দিরের বঙ্গীয় স্থাপত্য শৈলীতে, শ্রমজীবীরা তো নিশ্চিত হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই ছিল। হায়,একে বলে গৌড়ীয় স্থাপত্য!
৩১ মে। ১৮৫৫ সালে এই দিনে দক্ষিণেশ্বরে প্রতিষ্ঠা হল সেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মন্দির। জাতে উঠে গেল দক্ষিণেশ্বর। হালিশহরের মেয়ে তখন জানবাজারের জমিদারনি। বৈধব্য নাকি নারীকে দুর্বল করে! পরাধীনতার কাল। ব্রিটিশের চোখে চোখ রেখে কথা বলেছ তুমি– মানুষের রাণী রাসমণি।
তাহলে হালিশহরের মেয়েটিকে নিয়ে দু চার কথা লিখে যাই…
মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই তো বড় কথা। মানুষের জন্য লড়াই করাই তো রাজনীতি। একটি মেয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়েনি, অথচ আমৃত্যু করে গেছে জন-রাজনীতি।
এখনও জলস্রোত বয়ে যায়…
দাঁড়িয়ে দেখি ভাগীরথী তীরে তোমাকে খুব মনে পড়ে।
তখন সতীদাহ প্রথা ছিল ইংরেজ আমলে।
চিতায় দাউদাউ জ্বলন্ত নারী।
এখন স্বাধীনতার উত্তরকাল প্রতিদিন ধর্ষিতা নারীর দেহ তোমার উপকূলে কোথায় নিরাপত্তা, কোথায় নজরদারি?
আজ মনে পড়ে,
তুমি লড়েছিলে,সে লড়াই ছিল লড়াইয়ের মতো লড়াই। কতো হিম্মৎ নিয়ে ইংরেজের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলে জানবাজারে একাই।
এই মেয়েটি কিভাবে নারী হয়ে যায়, কিভাবে নারী হয়ে ওঠে মহীয়সী তা বুঝিনি তো আগে। মেয়েটি জন্মেছিল এই গঞ্জে,কোনোদিন ছিল সামাজিক আন্দোলনের পুরোভাগে।
মেয়েটি ধীবর কন্যা, নাকি কৃষিজীবী অথবা ঘরামির মেয়ে,তা নিয়ে চলুক না বিতর্ক। পড়াশুনো কতদূর ছিল কে জানে? অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষের পক্ষে তাঁর দৃষ্টি তো ছিল সতর্ক।
দক্ষিণেশ্বর মন্দির তাঁর হাতে নির্মাণ। রামকৃষ্ণ তাঁর আমলেই পরমহংস হয়ে যান। এসব বোধহয় তেমন বড় কথা নয়। সতীদাহের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন তিনি। ইংরেজের বিরুদ্ধে তলোয়ার হাতে তিনি।ধীবরদের লড়াইয়ের পাশে তিনি।
এসব তো মানব ধর্মের কথা—এছাড়া অন্য কোন ধর্ম বড় নয়। এতেই তো নারীত্বের মহান জয়।
শিক্ষার দুয়ারে কে করেছিল আঘাত?প্রেসিডেন্সি কলেজ-জাতীয় গ্রন্থাগারের পত্তন-বনিয়াদ! আর কত সব নির্মাণ সব স্নানঘাট– বাবুঘাট, আহিরীটোলা ঘাট, নিমতলা ঘাট….
এই তো সেই মেয়ে বাড়িয়েছে সহযোগী দীর্ঘ হাত।
মেয়েটি নাকি বর্ণে ছিল শূদ্রা। তাতে কি এলো আর গেল? ন্যূনতম লেখাপড়া জানা মেয়েটি রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় সাম্রাজ্যবাদীর নিদ্রা কেড়ে নিয়েছিল।
এমন মেয়ে কোনোদিন জন্মেছিল এই গাঁয়ে ভাগীরথী তীরে। এমন নারীকে কি ভোলা যায়?এইসব স্মৃতি কি কখনও ধূসরতা পায়!
আমাদের গাঁয়ের মেয়ে তখন তো আর মেয়ে নয়,নারী-লোকমাতা। বিধাতাকে তুড়ি মেরে সে নিজেই হয়ে উঠেছে মানবত্রাতা।
এই নারীটিকে যদি ভালোবাসি,প্রণত হই অনুরাগে, তাতে কি কেউ মারমুখী হবে চরম আক্রোশে ক্রোধান্ধ-রাগে?
হে মাতা, মহিয়সী নারী!
কোথায় লুকিয়ে রেখে গেছ সেই শানিত তরবারি?
ছবিঃ হালিশহর রাণী রাসমণি ঘাটে নবরত্ন স্থাপত্যের অনুকরণে ভবতারিণী মন্দির ২) আমাদের মেয়ে রাণী রাসমণি