আজ সকালে তোমাদের পায়ের পাতায় প্রণাম রাখি

বিশ্ব শ্রমজীবী নারী দিবসঃ
রূপান্তরকামীদের সঙ্গে আমি
তমাল সাহা

আজ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস। এই নারী দিবসের আগে ‘আন্তর্জাতিক’ ও ‘শ্রমজীবী’ শব্দ দুটি একটি অন্যমাত্রা এনে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক-এ মেয়েরা কেমন আছে রূপান্তরীরা কেমন আছে জানিনা। শ্রমিষ্ঠ জীবন কতদূর তাদের উন্নতির পথে নিয়ে গেছে জানিনা। শেষ পর্যন্ত আমরা কৌতূহলী হয়ে অদূর গাঙ্গেয় উপত্যকায় এইসব রূপান্তরকামী এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কত শব্দ ট্রান্সজেন্ডার হিজরা নপুংসক অপ্সরা কিন্নর বা কিন্নরী কত শব্দ খুঁজি।

পৃথিবীর সব রঙ নিভে যায়, সূর্য অস্ত যায়, ডানায় রোদের গন্ধ মুছে ফেলে চিল। অপরূপ জ্যোৎস্নার আলোয় চাঁদ পৃথিবীর গায়ে ছুঁড়ে দেয় লক্ষ লক্ষ তারা, নদীর জলে আলো ফেলে, করে ঝিলমিল। রূপান্তরকামীরা দুঃসহ যাপিত জীবন নিয়ে আলো ফেলে আমাদের চোখে। এ অঞ্চলে এই রূপান্তরকামীদের সংগঠন রয়েছে। তারা সামাজিক কল্যাণে ব্রতী একটি সংস্থা। লকডাউনে তাদের দেখেছি যতটা সম্ভব রাস্তার ধারে, লাইন ধারের বস্তিতে দানাপানি বিতরণ করতে। বস্তির মানুষ, হাভাতে মানুষের পাশে এরা দাঁড়িয়েছে।

তাদের অন্যতম পরিচালক অর্ঘ্যর সঙ্গে আজ কথা হল। সে জানালো তাদের জীবনযাত্রার কথা। অর্ঘ্যকে আমি অর্ঘ্য বাবু বলবো না, অর্ঘ্য দেবী বলব কিছুই বুঝতে পারি না। হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এরা মানুষ এটাই বড় কথা। এদের যাপিত জীবন নিয়ে অনেক কথা হল। তারা সামাজিক মর্যাদা পায় না এ কথা তারা যেমন জানালো, তাদের মানুষ যেমন হিজড়ের চোখে দেখে সে কথাও জানালো। অর্ঘ্য জানালো এইভাবে কোনো সংবাদপত্রের পক্ষ থেকে বিশেষ করে আঞ্চলিক ভাবে তাদের মর্যাদা দিয়ে, এই আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসে গুরুত্ব দিয়ে তাদের কাছে কেউ আসেনি। তাদের সুখ-দুঃখ জীবনযন্ত্রণার কথা কেউ জানতে চায়নি।

অর্ঘ্য বলে, লড়াই করেছি। রাজনৈতিক নেতাদের কাছে গিয়েছি, প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছি। কিন্তু কোনো কিছুই সুবিধা করে উঠতে পারিনি। আমরা চাই মনুষ্যত্বের মর্যাদা। আমরা কোথাও ঠিকঠাক বসবাস করতে পারিনা। কেউ আমাদের আশ্রয় দিতে চায় না। আমাদের দেখে তারা কেমন যেন আঁতকে ওঠে। ‌এই অবস্থার অবসান হোক। আপনারা আমাদের পাশে থাকুন।এই পৃথিবী তো সকলের জন্য ।এই আলো বাতাস জল বায়ু কে না গায়ে মাখতে চায়!

অন্য এক রূপান্তরকামী পারুল বলে, আমাদের কেউ হিজড়ে বলে, কেউ নপুংসক বলে। কেউ বলে, অপ্সরা, কিন্নর কিন্নরী। হিজড়ে, নপুংসক তো অপমানজনক শব্দ।সে যাই বলুক, আর বাকি শব্দগুলো শ্রুতিমধুর হলেও আসলে আমাদের কাছে একটা বিদ্রূপাত্মক-ব্যঙ্গাত্মক ধ্বনি। তারা আমাদের কাছের করে নেয় না। রাস্তায় কোন মহিলাকে আপনি যদি দেখেন, এই মহিলা! এই মহিলা! বলে কি ডাকতে পারেন? হয় তার নাম ধরে ডাকবেন, নাম না জানলে দিদি বা ম্যাম বলে ডাকবেন। কিন্তু আমাদের দেখলেই এই সম্মানজনক ডাকে উচ্চারণের কথা তাদের মনে পড়ে না। তারা আমাদের সমাজের বাইরে রাখতে চায়। অপ্সরা কিন্নর কিন্নরীরা কি মর্ত্যের মানুষ, এই সমাজে থাকে? তাহলে এই ডাকে মাটির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া কেন? এই প্রশ্ন তোলে পারুল।

আমাদের বলে হিজড়া!
আমাদের সৃজন ক্ষমতা নেই, গর্ভধারণের ক্ষমতা নেই হয় তো বা, কিন্তু একটা নবজাতক শিশুকে কোলে করে যখন আমরা একটা অনুষ্ঠান করি, আনন্দে মেতে উঠি সেখানে আমাদের পেটের জন্য উপার্জনটাই বড় কথা নয়,ওই শিশু চিরজীবী হোক, সুন্দর হয়ে উঠুক তখন ঐ শিশুটি আমার নিজেরই বলে মনে হবে। কারণ আমাকে তো কেউ আর কোনদিন বাবা, কেউ মা বলে ডাকবে না। সেই সুখটা আমরা অনুভব করি। আপনারা বুঝুন আর না বুঝুন।

সে আরো বলে,মাতৃত্ব বা পুরুষত্ব কি আমরা জানি না। কিন্তু একটা সৃজনশীল বস্তু, একটা সৃজনশীল প্রাণময় বস্তুকে কোলে করে একটা মা, একটা বাবার যা অনুভব হয় আমরা তো দেখি, আমাদের মধ্যেও সেই অনুভবটা জাগ্রত হয়। কিন্তু সামাজিক মর্যাদা কোথায়? মানুষ মঙ্গল গ্রহে চলে যাচ্ছে বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে। বাস্তবতা নিয়ে কথা হচ্ছে, কিন্তু আমাদের জীবনের বাস্তবতা কে কবে বুঝবে? আমাদেরও তো প্রগতি আছে, উন্নতি আছে তাই না? আমাদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব কে নেবে? আমাদের প্রজাতির মানুষ এখন কোনো কলেজের অধ্যক্ষ,প্রফেসার হয়েছেন তাদেরও তো মর্যাদা রয়েছে। কিন্তু শিক্ষাগত সেই যোগ্যতা থাকলেও সমাজ কি তাদের সেইভাবে গ্রহণ করেছে? তাদের গায়ে হিজড়ের গন্ধ আজও লেগে আছে!

আজকের এই নারী দিবস, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আমাদের এই দুঃখ বিষাদের কথা কে বুঝবে?