বইমেলার সেই সব দিনগুলি
তমাল সাহা

বইমেলার তেজ

বইমেলার সেইসব নয় ছয় কাণ্ড ঘটে যাওয়া দিনগুলি এই শীতের প্রহরে মনে পড়ে।
মনে পড়ে গেল ঘন রোঁয়া ওঠা কালো রেখার সেই গণ্ডদেশগুলি! চোখের ঔজ্জ্বল্য ঠিকরে পড়ছে কত সব স্বপ্নময় অক্ষর নিয়ে বইমেলার প্রান্তরে। এইসব তরুণরা কোনোদিন দেয়াল চুনকাম করে কালো অক্ষরে কতসব বারুদগন্ধী লিখন নির্মাণ করেছিল। সেইসব তরুণেরাই অন্যভাবে বইমেলার প্রান্তরে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদী মিছিল করতো, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শামিল হয়ে প্রতিবাদ করতো। এখন আর সেই সব বইমেলা হয় না! এখানেই লুকিয়ে ছিল অক্ষরের আগুন, বইমেলার তেজ।

কবি যখন ফেরিওয়ালা

বইমেলায় বড় কবি ছোট কবিদের বই ফেরি করছে এমনও দেখেছি। সময়কে দেখেছিল আর প্রতিমুহূর্তে কবিতা লিখেছিল যে অগ্রজ কবি সেই কবি বলেছিল, পুঁটি মাছের পরান লইয়া কবিতা লেখা যায় না। সেই প্রজন্মের কবিরা বইমেলার চত্বরে কোথাও বসে জটলা করতো। আরো দেখেছি পুলিশের টহলদারি দেখলে কোনো কবি কবিতা পাঠ করতে করতে পুলিশের চেয়ে কবি বড় এসব ঘোষণা করে দিত। ওরে পুলিশ! কবিকে দেখে তুই টুপিটা খুলিস। এখন সেইসব কবিদের শাব্দিক দৌরাত্ম্য দেখিনা বই মেলার মাঠে।

শাসকের পায়ে রোদ

তখন শাসকের পায়ে পড়ার এতো ঝোঁক ছিল না। অন্যভাবে জেগে ছিল বই ভালোবাসার মানুষদের আলো। এখন বইমেলায় একজনই ঘন্টা বাজায়। অক্ষর দালালেরা শাসকের পাশাপাশি থাকে। এসব ভাবনা তখন কারো মাথায়ও ছিল না।

বাসন্তিক হাওয়া

বজ্রবাহীদের উত্তেজনা কি মরে যায়! গাঙ্গেয় বাতাস অত নেমকহারামি করে না। মাঠের অদূরেই তো পড়েছিল সরোজ দত্তের লাশ। তা স্তিমিত হলেও উত্তেজনা ছিল চেতনায় মননে। সময় পাল্টানোর আশাবাদী কবিরা জড়ো হত কবিতা পাঠ করতো। সেই পুরনো দিন নির্মাণ পুনর্নির্মাণ বিনির্মাণের আলোচনা হতো। পাকানো তামাক পাতায় আগুন লাগানো মুখের ধোঁয়া কেঁপে কেঁপে উঠে যেত শীতের হিম মেখে আকাশের দিকে।
বিড়ি বই বৈশ্বানর বোধ করি একসাথে খেলা করতো । ‌
তখন জেলখানার ঘটনা নিয়ে কত লেখা বেরুতো, বেরুতো জরুরি অবস্থার লেখা!

ক্যাটালগ নেশাতুর

কত রকম নেশা থাকে, কত রকম পাগল থাকে বইমেলার উঠোনে। এসব আমার খুব চোখে পড়ে এবং মনেও পড়ে। তারা প্রতিটি বইঘরে ঢুকতো, বই দেখতো, নাড়াচাড়া করতো কিন্তু কিনতে দেখিনি। যে যে স্টল থেকে বইয়ের ক্যাটালগ দেয়া হতো তারা সব ক্যাটালগ বা অন্য কোনো লিফলেট সবই সংগ্রহ করে সাইড ব্যাগে ভরতো। এখন সাইড ব্যাগওয়ালা সেইসব তরুণ খুব বেশি দেখি না। ব্যাগেরও রকম ফের হয়ে গেছে। একজনকে জিজ্ঞেস করি, এতো ক্যাটালগ সংগ্রহ করো কেন? সে বলে, আরে! বই কিনি আর না কিনি, না পড়লেও তো সাহিত্যিকদের নাম বইয়ের নাম এর থেকে জানা যায়!
আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি।

বিকৃত ও বিক্রিত

ময়দানে হত দুটো বইমেলা পরে দুটো এক হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থমেলা ছিল সরকারি আর পাবলিশার্সদের একটি মেলা ক্যালকাটা বুক ফেয়ার। পরে কলকাতা বুক ফেয়ার হয়ে যায়।
বইমেলা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পায়। শাসককে কোনোদিনও দেখিনি বইমেলা উদ্বোধন করছে নিজের হাতে। সময় পাল্টায়। শাসক নিজেই যখন পণ্ডিত তখন সুবিধাজীবী কর্তাদেরও খুঁজে পাওয়া যায়।
বইমেলা থেকে আয়, বিদেশ সফরের সুযোগ-সুবিধা মেলে, ধান্দাবাজি আরো কত কী ঘটে যায়! এসব এক বিখ্যাত প্রকাশকের লেখা থেকে জানাও যায়। কত সব নতুন মানুষ একদিন বইমেলায় উদ্বোধন করেছিল এখন সেই দৃশ্যমানতা অন্যরকম বিকৃত ও বিক্রিত হয়ে যায়!
কবে কারা উদ্বোধক লেখা হয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়।

১৯৭৬ এ এল ডায়াস,১৯৭৭ মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়,১৯৭৮ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়,১৯৭৯ তুষারকান্তি ঘোষ,১৯৮০ ভবতোষ দত্ত,১৯৮১ অমর্ত্য সেন,১৯৮২ প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত,১৯৮৩ দেবীপদ ভট্টাচার্য,১৯৮৪ মুলকরাজ আনন্দ,
১৯৮৫ রমারঞ্জন মুখোপাধ্যায়,১৯৮৬ সৈয়দ নুরুল হাসান,১৯৮৭ অশীন দাশগুপ্ত,১৯৮৮ রাজা রামান্না,১৯৮৯ অ্যান্ড্রে লেভিন,১৯৯০ অসীমা চট্টোপাধ্যায়,১৯৯১ বি ডি নাগচৌধুরী,১৯৯২ অম্লান দত্ত,১৯৯৩ মৃণাল সেন,১৯৯৪ ইউ আর অনন্তমূর্তি,১৯৯৫ রঘুনাথ রেড্ডি,১৯৯৬ তপন রায়চৌধুরী,১৯৯৭ জাঁক দেরিদা,১৯৯৮ অ্যালেন গ্রাঁ,১৯৯৯ শামসুর রাহমান,২০০০ চিন্তামণি কর,২০০১ পেরে ভিসিয়েন,২০০২ রীতা রহমান,২০০৩ লুই তোলেদো সাঁদে,২০০৪ রাউল জুরিটা,২০০৫ ড্যানিয়েল পেনাক,২০০৬ মারিয়া ফার্নান্দো স্যান্তিগো,২০০৭ টমাস কেনেলি,২০০৮ পল থেরক্স,২০০৯ আলেক্সান্ডার ম্যাক কল স্মিথ,২০১০ জর্জ ভলপি,২০১১ রিচার্ড ফোর্ড,২০১২ বেপে সেভারগিনি,২০১৩ আনিসুজ্জামান,২০১৪ মমতা ব্যানার্জি,২০১৫ অনিতা আনন্দ,২০১৬ মাগেলা বাউদিওন,২০১৭ মমতা ব্যানার্জি,২০১৮ মমতা ব্যানার্জি,২০১৯ মমতা ব্যানার্জি,২০২০ মমতা ব্যানার্জি,২০২২ মমতা ব্যানার্জি ও কে এম খালিদ,২০২৩ মমতা ব্যানার্জি
২০২৪ মমতা ব্যানার্জি

ব-য়ে বই, ব-য়ে বন্ধু, ব-য়ে বন্দুক,ব-য়ে ব্রেখট–
বই হলো হাতিয়ার,ওটা হাতে তুলে নাও।