ফুটপাতে কালীর মেলাঃ আমরা মা কালী বেচে খাই
তমাল সাহা
মা নিজেই বলে,
জীবন তোদের জোড়াতালি
আমায় বেচে খা, জয় মা কালী!
কি নেই এই শহরে? কাঁচরাপাড়া স্টেশন থেকে বাগমোড় পর্যন্ত কবিগুরু রবীন্দ্র পথ— বাণিজ্য কেন্দ্র বাণিজ্য শহর।
দুদিকে ফুটপাত। অমাবস্যার মরশুম। ফর্সা নারী আর পাবো কোথায়, রাস্তার দুই দিকে কালো মেয়ের নগ্ন নাচন। এক হাতে মুণ্ডু ঝোলে, অন্য হাতে খড়্গ উঁচিয়ে। কৃত্তিবাস পদতলে শুয়ে। ডানহাত বালিশ বানিয়ে মাথা রেখে উপরের দিকে তাকিয়ে নগ্ন মাতৃপ্রতিমা দেখে। লজ্জায় কালী জিভ কাটে।
২০০ থেকে ৩০০ মোটামুটি বড় সাইজের কালী নিয়ে বসেছে মা বেচনেওয়ালারা। বিক্রেতারা সবই জোয়ান মরদ নয়, তার মধ্যে মহিলারাও রয়েছে। খুঁজে খুঁজে একজন নারী পেলাম মধ্যবয়স্কা,নাম তারাময়ী। আরো দুজনকে পেলাম, তাদের নাম যোগমায়া এবং পুণ্যব্রতী।
এই তিনটি নাম শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। মনে মনে প্রণাম করি।
মা কালী বিক্রেতা পুরুষরা কেউ সুশীল কেউ সুবীর কেউ ধনঞ্জয় কেউ মনোরঞ্জন। তবে সকলেরই পদবী দেখি পাল। একজনার পদবী পেলাম সরকার।
ছোট মা ছোট দাম, মাঝারি মা মাঝারি দাম, বড়মা বড়দাম। আমি তারাময়ীকে বলি, মাসি! মা তোমার আবার ছোট বড় হয় নাকি! মায়েদের তো একই দাম? মাসি আমাকে বলে, তোমার তো বুদ্ধিশুদ্ধি কম। সব মায়ের মূল্য একই কিন্তু আমি তো অর্থমূল্যের কথা বলছি! দুনিয়ায় মা আবার কিনতে পাওয়া যায় নাকি? মা অমূল্য তাকে কি কেনা যায়?
আমরা তো স্পর্ধা, সাহস দেখিয়ে কাল নিয়ন্ত্রণকারী মহাকালী কালীকে বেচি। এসবই মা জানে পেট বাঁচাতে পয়সা লাগে।
সুবীর পাল বলে, হালিশহর বাগমোড়, কল্যাণ সংঘ কল্যাণী রথতলা, বীরপাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা এসেছি। বেচাকেনা চলবে রাত সাড়ে বারোটা একটা পর্যন্ত। সব মাল(!) হয়তো বিক্রি হবে না, এখানেই রেখে দিতে হবে। কাল সকালে বিক্রি হবে আশা করি। পুজো তো কাল রাত গভীরে হবে।
আমি বলি, মাকে তুমি মাল বললে?
সুবীর বলে, মাটি দিয়ে মাকে আমরা গড়ি। দরকার হলে ভাঙি, মাকে আমরা যা ইচ্ছা তাই বলতে পারি। আমরা মাকে অত সুন্দর রূপ দিয়ে বানাই আবার বিক্রি করি। পটুয়া মৃৎশিল্পী ছাড়া কেউ কি এসব পারে? দুনিয়ায় যা সব বিক্রি হয় তাকে তো মালই বলে। আপনারা শুদ্ধ ভাষায় বলেন সামগ্রী বা পণ্য।
আমি ভাবি, এসব তো দর্শনের কথা!
আমি বলি মূর্তি বিক্রি না হলে কি করবে? ধনঞ্জয় বলে, অনেকেই অন্যান্য মাসে বিভিন্ন অমাবস্যায় মানসিকে কালীপুজো করে। এই কালীগুলোকেই কালো রং করে বিক্রি করে দিই। আমি বলি, সবই তো আর বিক্রি হয়ে যাবে না, তখন কি করবে! ধনঞ্জয় বলে, এর উপায়ও আমাদের জানা আছে। মাথাটা কেটে অন্য মাথা লাগিয়ে দেব। অন্য মূর্তি হয়ে যাবে। ওসব আমাদের হাতের কারিগরি।
আমি বলি, পাল মশাই আমার প্রণাম গ্রহণ করুন।
মনোরঞ্জন পালকে বলি, মূর্তির দাম কত? একদম ছোট্ট বাচ্চা মূর্তি দুশ টাকা। তাছাড়া পাঁচশ টাকা, ন’শ টাকা, এগারোশ টাকা, তিন- পাঁচ- সাত হাজার টাকা বিভিন্ন মূর্তির বিভিন্ন দাম।
মাঝখান থেকে সুবীর পাল বলে ওঠে, নেতারা আমাদের সাধারণ মানুষের চাকরি বেচে, রেশন বেচে, রেল- বিমানবন্দর বেচে, দেশ বেচে খায়। আমরাই বা ছাড়বো কেন? আমরা মাকে বেচে খাই!