রবীন্দ্রনাথ এবং পুলিশ 

জুজুকে ভয় ছিল তার ছোটবেলা থেকেই। জুজুদের ভয়ঙ্কর কাণ্ডকারখানা সে স্বচক্ষেই দেখেছিল। জুজুর ভয়ে সে শঙ্কিত তা সে খোলসা করেই বলেছিল ‘জীবন স্মৃতি’র পাতায়—‘পুলিসম্যানের কর্তব্য সম্পর্কে অত্যন্ত মোটামুটি একটা ধারণা আমার ছিল। আমি জানিতাম একটা লোককে অপরাধী বলিয়া তাহাদের হাতে দিবা মাত্রই, কুমির যেমন খাঁজকাটা দাঁতের মধ্যে শিকারকে বিদ্ধ করিয়া জলের তলে অদৃশ্য হইয়া যায়, তেমনি করিয়া হতভাগ্যকে চাপিয়া ধরিয়া অতলস্পর্শ থানার মধ্যে অন্তর্নিহিত হওয়াই পুলিশ কর্মচারীর স্বাভাবিক ধর্ম। এরূপ নির্মম শাসনবিধি হইতে নিরপরাধ বালকের পরিত্রাণ কোথায়,তাহা ভাবিয়া না পাইয়া একেবারে অন্তঃপুরে দৌড় দিলাম,পশ্চাতে তাহারা অনুসরণ করিতেছে এই অন্ধভয় আমার সমস্ত পৃষ্ঠদেশ কুন্ঠিত করিয়া তুলিল।’

রবীন্দ্রনাথকে পুলিশ কোনোদিন গ্রেপ্তার করেনি। কোনোদিন থানার কক্ষেও নিয়ে যায়নি। তাতেই তাঁর মানসিক অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল। ‌ শেষ পর্যন্ত সে এতই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল যে ‘কালান্তর’-এ সোজাসুজি লিখেই ফেলল—‘পুলিশ যে চারায় একবার অল্পমাত্র দাঁত বসাইয়াছে,সে চারায় কোন কোন কালে ফুলও ফোটে না,ফলও ধরে না। উহার লালায় বিষ আছে।….. পুলিশের মারের তো কোথায় নাই। তার স্পর্শই সাংঘাতিক।…উহাদের খাতা যে গুপ্ত খাতা, উহাদের চাল যেগুপ্ত চাল। (ছোট ও বড়, কালান্তর ১৩২৪)।

আজীবন সে পুলিশকে এড়িয়েই চলেছে । কিন্তু পুলিশ নাছোড়। তাঁকে কিছুতেই তারা ছাড়বে না। তাঁর মৃত্যুর এতদিন পর তারা সুযোগ পেয়েছে। তারা আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ফেলেছে তাঁর শান্তিনিকেতন। একেবারে নিশ্ছিদ্র পাহারা। সে যে কতরকমের পুলিশ! রাজ্যের সাধারণ পুলিশ, সিআইডি, কেন্দ্রের সিবিআই। শুধু কি এই? বাপরে বাপ!সুদূর ইন্টারপোলে পর্যন্ত খবর চলে গিয়েছে। জ্যান্ত অবস্থায় হাতে না পেলে কি হবে মৃত্যুর পর তাঁর বিদেহী অস্তিত্বই যথেষ্ট। জুজুরা তাদের হাতের সুখ মিটিয়ে নেবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দিয়েই।

২৫ মার্চ ২০০৪, বৃহস্পতিবার সকালটা কি খুবই খারাপ ছিল? সেদিন সকালেই সংবাদটা শিরোনাম হয়ে চাউর হল।চুরি গেছে তাঁর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পদক। শান্তিনিকেতনের আনাচে-কানাচে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে পুলিশের বুটের শব্দ। গোয়েন্দাদের মারকুটে চোখ সারা উত্তরায়ণ জুড়ে। পুলিশে পুলিশে বিচিত্রা ভবন ছয়লাপ।

চুরিবিদ্যা এবং চোর সম্পর্কিত ভাবনাও তাঁর মাথায় খেলেছিল কোনদিন, না হলে সে লিখবে কেন? ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে’। অথবা ‘যা-কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর।’

নোবেল চুরির সম্ভাব্য বিষয়টি হয়তো বা সে আগেই টের পেয়েছিল। না হলে কেন সে লিখতে গিয়ে ছিল এইসব অবশ্যম্ভাবী ছত্র— ‘চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে, চোর চাই, যে করেই হোক/হোক না সে যেই কোন লোক,চোর চাই/ নইলে মোদের যাবে মান।’

‌নিজের পদকটি খোয়া যাওয়ায় তাঁর মুখে এখন কুটিকুটি হাসি। ‌তাঁর প্রশ্ন, বস্তুটি হাতসাফাই হয়ে যাওয়ার পর এত লোকলস্কর মন্ত্রী-অমার্ত,পাইক- বরকন্দাজ, সিপাহশালার কেন? তাহলে কি হারিয়ে যাওয়ার আগে ধাতব চাকতিটির কোনো গুরুত্ব ছিল না? অবশ্য এই নোবেল পদক সে বিড়ম্বিতই ছিল, তাহলে কেন সে সংবর্ধনা আসরে বলেছিল, ‘এমন সময় কি জন্য যে বিদেশ হতে আমি সম্মান লাভ করলুম,তা এখনও পর্যন্ত আমি নিজেই করেভালো উপলব্ধি করতে পারিনি।'(২৩ নভেম্বর,১৯১৩)।

পরাধীন ভারতে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সরাসরি পথে নেমেছিল সে। সে সময় পুলিশ তাকে টানাহেঁচড়া না করলেও, স্বাধীন দেশেই রাজ ব্যবস্থায় পুলিশ তাঁকে হাতেনাতে না ‘পারুক তাঁর নির্মাণ বিশ্বভারতী’কে যে পুলিশ নজরে বেঁধে ফেলেছে তা আমাদের জাতীয় লজ্জা। সে বুঝেছিল সরকারের পক্ষে দেশের ঐতিহ্য গৌরবময় কোন বস্তুই আগলে রাখা সম্ভব নয়। ‌কারণ এইসব দুর্নীতিবাজ নেতা আমলা দাগি সাংসদ পরিকীর্ণ এদেশের আইন শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বেই। নিরাপত্তাহীনতা নেমে আসবে লোকজীবনের। ঋষিকল্পদ্রষ্টা অনিবার্যভাবে তা দেখতেও পেয়েছিল— ‘মহারাজ ভয়ে থাকে পুলিশের থানাতে, /আইন বানায় যত পারেনা তা মানাতে। /চর ফিরে তাকে তাকে,/ সাধু যদি ছাড়া থাকে, /খোঁজ পেলে নৃপ তিরে হয় তাহা জানাতে—/ রক্ষা করিতে তারে রাখে জেলখানাতে।’