২৫ ভাদ্র, এবার পড়েছে ১০ সেপ্টেম্বর। এদিন কবি রাম বসুর জন্মদিন। সেই যে পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে….

তমুর গল্পঃ

পরাণ মাঝির সঙ্গে দেখা
তমাল সাহা

তমুর সৌভাগ্য অনেক প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছে। পরাণ মাঝির সঙ্গেও তার দেখা হয়েছিল কোনোদিন। তমু তার সঙ্গে প্রাণ ভরে কথাও বলেছে। তেভাগা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তমুর অনেক কিছু জানার ইচ্ছা ছিল তার মুখে। কারণ এই আন্দোলন ও কবি অনেক ক্ষেত্রে এক হয়ে গিয়েছেন বিশেষ করে বামপন্থী কবিরা।

সত্তর দশকের মধ্যভাগে ইডেন গার্ডেনে অনুষ্ঠিত হতো যুব উৎসব। যতদূর মনে পড়ে সপ্তাহ ব্যাপী চলতো সেই বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কোনো অনুষ্ঠানের খামতি ছিল না তাতে। সেখানে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান সে এক কবি অরণ্য! সে সেখানে কবিতা পাঠ শুনেছে রাম বসু, গোলাম কুদ্দুস, অমিতাভ দাশগুপ্ত, মণীন্দ্র রায়, আশিস সান্যাল, তরুণ সান্যাল,মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের কন্ঠে।এসব তো তমুর কাছে এক দুর্লভ প্রাপ্তি বই কি!

যাক সেসব কথা।সঙ্কেত তারা পেয়েছিল অনেক আগেই। নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, হরিপুর, ভাঙরের শস্যক্ষেত ও খামারবাড়ির চোখগুলি হয়ে উঠেছিল অশ্রুনদী। কাকদ্বীপের আকাশকে নিশ্চিত তখন ডেকে বলেছিল রাত্রিগামী বাতাস– অথৈ রাত্রির কাছে কোনো প্রার্থনা ছিল না আমার/ নক্ষত্রের চোখের জলের জ্বলজ্বলে মুহূর্তের গায়ে/ মাখিয়ে দিয়েছি চন্দন যেন শান্তি পায় কাঙাল ভুবন।

আর তখনই তমুর মনে পড়ে যায় পরাণ মাঝির অনাহত কন্ঠস্বর–
অমল আনন্দ শুধু নিজেকে হারানো /উদ্দাম ঢেউয়ের সংবর্তে /জেলে ডিঙি ঠেলে দিয়ে/ নীলিমার কাছাকাছি যাওয়া।

পড়ন্ত এই শীতের প্রহারে ডেকে বলি– “পরাণ মাঝি ই…ই…ই…! ও পরাণ মাঝি!
এখন তো ভাঁটির টান।
তুমি আমাদের কোন উজানে নিয়ে যাও!”
পরাণ মাঝি বলে, “কবিতার উজানে”–
“যখন ভাঁটার সময় তখনই তো উজানের কবিতা লিখতে হয়–
তাপ নেব হাতে পায়ে কপালে দু চোখে/ জল খাবো, পৃথিবীকে চেয়ে দেখবো প্রেমিকের চোখে/ তারপর মেয়েটাকে চুমু দিয়ে ঢলে পড়বো হলুদ আগুনে নয় নিজের হাতে জ্বালা সবুজ আগুনে।”
১১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬। প্রস্তুত হলো সে সবুজ আগুন জ্বালাতে।

সেটা ২০০৪ সাল। পরাণ মাঝি এসেছে গোকুলপুর গঞ্জে। সঙ্গে এসেছে মাঝি বউ। এই গঞ্জের মাটির ঘরকে, গাঁয়ের গেরস্থালিকে সে কতই না কাছের করে নিয়েছিল। সে উঠেছিল দীপকের ঘরে। ওই যে বেঁটেখাটো ছেলেটা “নান্দনিক” সাহিত্য করে! বেঁটেখাটো দীপক কর খুঁজে বের করেছিল পরাণ মাঝিকে। সে পরাণ মাঝিকে জ্যেঠু বলে ডাকতো। মাঝি বউকে, জ্যেঠিমা।

কল্যাণী বইমেলা, ২০০৩, দীপক বার করে ফেললো পরাণ মাঝির এক ফর্মার একটা কবিতার বই– “সমুদ্র যে কাল”। সংবর্ধনা দেওয়া হল পরাণ মাঝিকে নান্দনিক সাহিত্য সংসদের পক্ষ থেকে ২৮ মার্চ, ২০০৪। সেই “সমুদ্র যে কাল”– দীর্ঘ কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনালেন সংরক্ষিত সরিৎ কুমার মিত্র। তিনি প্রয়াত হয়েছেন। সভাপতির ভাষণে পরাণ মাঝির কাব্যচর্চা, যাপিত জীবন এবং সংগ্রাম নিয়ে সম্মোহিত আলোচনা করলেন কবি বীরেন্দ্র নাথ রক্ষিত। তিনিও প্রয়াত হয়েছেন।

‘পরাণ মাঝি এয়েচে’– এই সংবাদ যখন পৌঁছলো কাঁচরাপাড়ার ঈশ্বরগুপ্ত পরিষদের কাছে তখন সভাপতি জগদীশ মোদক, সম্পাদক মণি ভট্টাচার্য, সদস্য গোষ্ঠবিহারী দে, শমিত কর্মকারকে সঙ্গে নিয়ে চলে এলেন পরাণ মাঝিকে আরেকটি সংবর্ধনা জানাতে। অনুষ্ঠানটি খুবই জমে উঠলো গয়েশপুরের নেতাজি বিদ্যামন্দিরের ঘরোয়া অনুষঙ্গে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায়।

পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে। ৬০ এর দশকে তমু সেই প্রথম হাঁক শুনতে পায়। যদিও সে হাঁক দিয়েছিল ১৯৪৯ সালে– তেভাগা, কাকদ্বীপ, তেলেঙ্গানাকে একাকার করে দিয়ে আর তখনই রাম বসু হয়ে গেল পরাণ মাঝি!
কেমন ছিল সেই হাঁক?–
আমরা হেরে যাব না/ আমরা মরে যাব না / আমরা ভেসে যাব না।
পরাণ মাঝি দেখেছিল তেভাগা আন্দোলন। অদ্ভুত আশ্চর্য! তেভাগা আন্দোলন সম্পর্কিত বাম চেতনা সম্পন্ন দুই কবি মরে গেল এই কালবেলায়। যখন বামপন্থী সাইনবোর্ড লাগানো সরকার কেড়ে নিচ্ছে সিঙ্গুরের শস্যক্ষেত, নন্দীগ্রামের জোত জমি। চাষাভুষোর অশৌচের এই দুঃসময়ে নীরব অপমানে চলে গেলেন কি দুই কবি গোলাম কুদ্দুস ও রাম বসু?

পরাণ মাঝি রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিল ১৯৮৯ সালে। কবিতা, কাব্য নাট্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ, হো চি মিন-এর “প্রিজন ডায়েরি” র অনুবাদ, এমনকি “সাম্প্রতিক অস্তিত্ব ও মার্ক্সবাদ” বিতর্কিত গ্রন্থটিও সে লিখে ফেলেছিল। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত তার ধ্যানধারণা ছিল সম্পূর্ণ সহজাত। নিজস্ব বোধে উচ্চারিত কাব্যগ্রন্থ– “তোমাকে” ১৯৮৯, “যখন যন্ত্রণা”১৯৫৪, “দৃশ্যের দর্পণে” ১৯৫৬, মন্ত্রপুঁজি ১৯৬১, পাঠ করলেই সৃজনের অনন্য নির্মাণ চোখে পড়ে। শেখা যায় কিভাবে কবিতা লিখতে হয়, উদ্বোধনের কবিতা মানুষের জন্য। পরাণ মাঝি নাম পাল্টে “কনিষ্ক” হয়ে গিয়েছিল। লিখেছিল “ঘসেটি বেগম”, “মোঘল হাটের সন্ধ্যা”– এইসব উপন্যাস।

মাঝি ক্রমশ কবি হয়ে দেখেছিল অপূর্ব দৃশ্য। “অন্ধকার ঠায় দাঁড়িয়ে ভিজছে তার দিকে নজর নেই কারও। আরও কিছু দূর গিয়ে সে দেখতে পেল– টিভি ও বেতারে, মিডিয়ার দু’হাতে প্রতিশ্রুতির বন্যা/ তাজ বেঙ্গলে বিদেশি মালিক আর ধোপদুরস্ত বুদ্ধিজীবী/ বিরোধী পক্ষের ছক, হরতাল, ধর্ণা, পথ অবরোধ এবং বনধ/ কোটি কোটি বেকারের হন্যে চোখে নেশা/ নেতাদের দেওয়া ডেইলি ওয়েজেও হিস্যা, না পেলে– পটকা, গণ অবরোধ, বাতাস কাতরায় গন্ধকে ধোঁয়ায়/ অফিসের চেয়ার খালি, চিমনির ডোঙায় বাসা বাঁধে কাক/যেমন চলার কথা, অবিকল তেমন চলছে। আরও এগিয়েছিল সে– কিছুটা যেতেই ওপাড়ার হাঁদু বললেঃ দাদু, ওদিকে যাবেন না, মাল পড়ছে, মাল।”
এই দৃশ্য দেখার পর কবি বলে উঠেছিল, মাঝির দুর্জয় কন্ঠ তখন হতাশায় কাঁপে– “তাহলে কি আমাকেই জল ঢালতে হবে আমার চিতায়!”

এমন মাঝি কবিকে তমু প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেছে। জানতে চেয়েছে। সে একের পর এক উত্তর দিয়ে গেছে। কবিতা, আন্দোলন, সময়, মার্ক্সবাদ, কমিউনিস্ট পার্টি এবং রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে। তমুরা কজন, মানে দীপক, পরিতোষ, সিদ্ধেশ্বর, রণজয় ও তমু তাকে পায়ে পায়ে হেঁটে দেখিয়েছে কল্যাণী শহর, ঈশ্বরগুপ্তর জন্মভিটে, ঈশ্বরগুপ্ত সেতু পেরিয়ে হংসেশ্বরী মন্দির। যেতে যেতে তমু শুনেছে তার ফেলে আসা ধূসর স্মৃতি। সে তমুকে বলেছিল, কৃষক নেতা গজেন মালির গল্প। কি করে সুভাষ সরোবরে এসে পৌঁছেছিল কাকদ্বীপের সেই কুমির ছানা আর তমুদের বড় জাগুলিয়ার জঙ্গি যুবক অশোক বসুর কথা, যে কখনও বিদ্যুৎ, কখনও নিকুঞ্জ কখনও বা প্রকাশ রায় হয়ে মাতিয়ে দিয়েছিল লড়াইয়ের ময়দান। শেষ পর্যন্ত পরাণ মাঝিকে সামনে রেখে তমু লিখে ফেলে একটি কবিতা– “তাহার হাতে”।

সেটি পরবর্তীতে হালিসহর থেকে প্রকাশিত “ঋতুপত্র”- এ ছাপাও হয়ে যায়। সেই কন্ঠ এখন ঐশ্বর্য হয়ে তমুর চেতনায় আর হৃদয়ে উচ্চারিত হচ্ছে।
“কিছু কিছু মানুষ আছেন/ যাঁকে প্রণাম করলে / দুটো হাত হয়ে যায় ফুলের স্তবক।”

পরাণ মাঝিকে সামনে রেখে তমুর লিখে ফেলা সেই কবিতাটি–

অনেকটা ভাঙাচোরা পথ পেরিয়ে
সে এসেছে।
পথের দুপাশে যাপিত জীবন–
সে তো অন্য এক দেখা, অন্য হেঁটে চলা।

বৃষ্টির শরীর কেঁপেছিল কোনোদিন
বকুলের ঘ্রাণে।
অনেকদিন আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে
কতদিন আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে
এখনও কাদা তেমন বড় শুকোলো না
পারানি নৌকো গেল কোথায়!
তাকে অন্তত একবার ডাকো
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো
মাকড়সার জালের মতো বিদ্যুতের তার
ঘিরে ফেলেছে গাঁ গঞ্জের বসত
তবু ক্রমাগত লোডশেডিং আর লোডশেডিং
অন্ধকার আরও কালো হয়ে এলো।

লন্ঠনটা কাঁপছে
তার হাতে তুলে দাও
আলো সে আরও বাড়িয়ে দিক।

ছবিঃ বাম দিক থেকে বসে
কবিজায়া, কবি রাম বসু, তমাল সাহা, গোষ্ঠবিহারী দে
দাঁড়িয়ে– যুগান্তর মিত্র, শমিত কর্মকার