দৃশ্যমান নারী দিবস
তমাল সাহা
পুবে বঙ্গোপসাগরের তলদেশে যখন আড় ভাঙতে থাকে ভোরের সবিতা,
তখন প্রথম ক্যানিং লোকাল ধরতে হবে বলে সোনারপুর, বারুইপুর, বাঘাযতীন কলোনির মেয়েরা জেগে ওঠে।
নড়েচড়ে ওঠে ছিটে বেড়ার ঘরগুলি। মাথায় প্লাস্টিকের ছাউনি।
লক্ষ্মী পার্বতী শেফালী শিউলি কমলা গোলাপিরা ছুটতে ছুটতে ট্রেন ধরে,
ট্রেনের কামরা কলকল করে ওঠে,
একপ্রস্থ আলোচনা সেরে ফেলে তারা ট্রেনের কামরায় ভেতর।
এইসব ঘর সাফ সুতরো রাখার মাসিরা কেউ শিয়ালদায় নামে, কেউ নামে বিধান নগরে।
তারা বলে চলে জীবনের ভাগ্যলিপি—
কোন দিদিমণি মুখ ঝামটা দিয়েছিল, কোন দিদিমণি খুশি হয়ে বকশিশ দিয়েছিল, বার্থ ডে পার্টিতে বেশি হয়ে যাওয়া খাবার পরদিন তাকে দিয়েছিল, ম্যারেজ পার্টিতে কি যেন বলেনা গেট টুগেদার সেখানে মদ খেয়ে দাদামনি দিদিমনিকে চুমু খেয়েছিল গোলাপি তাও দেখেছিল সে কথা বলল সে শেফালিকে। এই আলোচনাতে তারা অন্যসুখ পায়।
আজ যে আন্তর্জাতিক মানে বিশাল মাপের নারী দিবস, তা ওরা জানেনা।
আজ নারী দিবস। লেনিনের স্ত্রী স্ক্রুপস্কায়া সভ্যতা নির্মাণে নারী শ্রমিকের কথা বলেছিল।
ম্যাক্সিম গোর্কি এঁকেছিল পাভেলের মায়ের ছবি— শ্রমিকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন পাভেলের মা, গরম রুটির ভেতরে গোপন ইশতেহার।
এইসব মনে পড়ে গেলে আমি হালিশহর ভাগীরথীর তীরে ইটভাটায় চলে যাই, আমি তো হালিশহরেই থাকি।
দেখি বিশাল ভাটি,দেখি ইট পুড়ছে। চিমনি দিয়ে বেরোচ্ছে ধোঁয়া
দূরে দেহাতি মেয়েরা, সাঁওতাল রমণীরা ফরমায় মাটি চেপে ইট বানাচ্ছে।কত দ্রুত তার কারিগরি।
মুখ জুড়ে তার গড়ানো ঘাম কিন্তু মেহনতের মজুরি? সে এক বিস্ময়!
বড় বড় মানুষদের ইমারত তৈরি হবে এইসব ইট দিয়ে। রোদে শুকোচ্ছে ইট। নারীদের হাতে মাটি পাচ্ছে ইটের রূপ।
অন্য ভাটায় গিয়ে দেখি ভাটি থেকে ইট বার করে আনছে নারীরা।
একটা মাথায় বইছে দশটা ইট।
কী সৌন্দর্যবোধ! ইটের সারি দিচ্ছে পরপর।
মাটি নারী শ্রম এইভাবে ইট হয়ে যাচ্ছে, আমার চোখের সামনে।
আর বিহার থেকে আসা সেই মেয়েটি যে সেভেন পর্যন্ত পড়েছে,তার নাম সরস্বতী।
সে কাঁচরাপাড়া কারখানার লোকোগেটের সামনে বোনকে নিয়ে আখ মাড়াই করে আখের রস বেচে।
মাড়াই-মেশিনের চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে তার পেশীগুলো পুরুষালী হয়ে উঠেছে।
মেহনতের ঘাম তার চোখে-মুখে।
আখের রস সে তুলে দিচ্ছে পুরুষ কামগারদের হাতে।
আর একজন নারী ছোলাছাতুর শরবত বিক্রি করছে ঠেলাগাড়ি দাঁড় করিয়ে।
ধবধবে কাচের গ্লাস, ছোলার শরবত উপরে ভাসছে কুচি কুচি পেঁয়াজ লঙ্কার টুকরো জিরের মশলা আর বরফগুঁড়ো।
নারীটির মুখের দিকে আমি তাকিয়ে থাকি।
এইভাবে নারীরা শরীর জুড়ানো শরবত হয়ে যায়।
আমি জিপি রোড ধরে হাঁটতে থাকি,
পৌঁছে যাই সাবেকি সাহেবি আমলের সেই নফর চাঁদ জুট মিলের বিশাল গেটের কাছে।
এমনিতে প্রায় সব জুট মিল বন্ধ হয়ে গেছে।
দুপুরের ভোঁ বাজবে। দেখি ঘরওয়ালি বৌটি গামছার খাবার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে গেটটার কাছে, বটগাছের নিচে মরদের খাবার নিয়ে।
প্রেম-মহব্বত বুঝি একেই বলে!
খাবার ,জোয়ান মরদ আর ঘরওয়ালির একটা গেরস্থালি জীবন তার সঙ্গে মিশে মেহনত— আমার চোখের সামনে একটি বিশেষ চিত্রের আভাস দেয়।
আজ সন্ধ্যায় আমি প্লাটফর্মে গিয়ে দাঁড়াই।
দেখি ভাঙাচোরা নারীর শরীর, ট্রেন থেকে নামে ওরা। কেউ প্লাইউড কারখানায়, প্লাস্টিক কারখানায়, কেউ রাবার ফ্যাক্টরিতে কাজ করে।
সারাদিন শেষে ক্লান্ত পায়ে বাড়ি ফেরে।
ভোরের ট্রেনে রানাঘাট শিমুরালি মদনপুর চাকদা থেকে নামতে দেখেছিলাম সবজির ঝুড়ি নিয়ে কচুর আঁটির বান্ডিল কোমরে বেঁধে
,ডিমের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে মাসিদের।
তারা মণ্ডলবাজারের দিকে চলে যায়।
আর ফুলমাসিরা বেলপাতা দুব্বো, তুলসীপাতা, ঝরা বিভিন্ন রংয়ের বিভিন্ন ফুল, রজনীগন্ধের মালা, গোলাপের তোড়া নিয়ে বসে কবিগুরু রবীন্দ্রপথের ধারে।
শ্রম, ফুল ও নারী একসঙ্গে মিলে গেলে দেবতা পুজো পায়,আমি বুঝি।
কল্যাণীর সতীমার মন্দিরের ডালিমতলার বাইরে দোকান পেতে যে নারীরা মাটির ঘোড়া আর প্রসাদী মাটির সরা বেচে তাদের খুব মায়াময় লাগে আমার চোখে।
ফিরতি পথে ট্রেনে যে অন্ধ মহিলা ভিক্ষের গান গেয়ে সুর বেচে উদাসী হয়ে যায়– জীবন রে তুই আনলি ক্যানে এই ভবের হাটে…
আমার চোখে তখন জলের বাষ্প,
একটি প্রণাম তার পায়ের দিকে ছুটে যায়।
রাত ক্রমাগত ঘন হতে থাকে।
স্তিমিত আকাশ, আকাশে চাঁদ ডাগর হয়ে ওঠে। নক্ষত্রেরা তাকে ঘিরে ধরে।
রাতের শেষ ট্রেনে ফিরে আসে ঝরে পড়া শেফালিরা, সাজিয়ারা, ফুলমতীরা। কোত্থেকে ফিরে আসে? সে তো সকলেই জানে।
শরীরের শেষ শ্রম বেচে মুখের মেকআপ ম্লান করে কোনমতে বাড়ি ফিরে আসে আমার প্রিয় নারীরা।
গাছে গাছে বসন্তের ফুলগুলি রটিয়ে দেয়– আজ নারী দিবস।