তালশাঁসের জীবন
তমাল সাহা

নৈসর্গিক আবহাওয়ায় প্রেমিকা রেমালকে দেখব বলে তোর কাছে গিয়েছিলাম রে ভাগীরথী! নেশাধরা হাওয়া উঠেছিল‌। বট পাকুড়ের ডাল সমূহের নড়াচড়া ছায়াও দেখেছিলাম। জলজীবীরা নদী তীরে নৌকো বেঁধে রেখে বসেছিল গাছের নিচে বেদির চাতালের উপরে তোর প্রতীক্ষায়। তোর বিধ্বংসী রূপ জলস্ফীতি দেখিয়ে নাচবি তুই ঘুঙুর বেঁধে পায়। এই মহাকাল বেলায় মহাকালী তুই ঘাট থেকে অদূরে ভুবনেশ্বরী মন্দিরের ভেতরে কি বসেছিলি? ভুবনেশ্বরী তুই- ই কি মহাকাল রেমাল হয়ে বেরিয়ে আসিস পৃথিবীর বারান্দায়? আমি তখন তাকিয়ে ছিলাম মন্দিরের দিকে স্থাপত্য চেতনায়।
তুই এলি না। তাই এখন দ্যুতিময় মধ্যাহ্নে ঘুরে বেড়াই রাস্তায়। তালশাঁসের জীবন খুঁজে বেড়াই।

কাঁচরাপাড়া স্টেশন থেকে বাগমোড় পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথ। রাস্তার দু’ধারে কতজন মানুষ তালশাঁসের জীবন নিয়ে বসে আছে। সে তো জনা পঞ্চাশেক হবে। বইয়ের চেয়ে রাস্তাকে আমি ভালোবাসি। রাস্তা থেকে কত রকম বর্ণমালা যে শিখি!

হারাধন লোধ। এসেছে সেই হরিণঘাটা থেকে।
সে বলে, আমার বাবার জমিন নাই। আপনারা বলেন, খেটে খুঁটে খাই। আমি বলি, কেটেকুটে খাই। আমার বাবার জমিন নাই, এই বাক্যটি সে বারবার কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলে। এই গাছের উপরে উঠি তালের কাঁদি কাটি, আবার তালের কাঁদি কোমরে বেঁধে নিচে নেমে আসি। জীবনের এই এক ওঠানামা সার্কাস।
মাটিতে তো নামি। তারপর তাল কেটে শাঁস বের করি আপনাদের খাওয়াই। তালের কাটাকুটি শরীর পড়ি থাকে। আমরা শাঁস খেয়ে চলে যাই। জানেন তো, আমার বাবার জমিন নাই।

প্রভাস গাইন, মধ্যবয়সী এক মানুষ। জাগুলিয়া থাকে। রাস্তার দুপারে দুই বাপ বেটা বসে। কেউ কারুর পরিচয় দিতে চায় না। আমি বিষয়টি জানতে পেরে বলি, তোমরা আলাদা আলাদা বসো কেন? বাপ বলে, বাপ বেটা কি একটা মানুষ? দুইটা মানুষ, দুইটা ব্যবসা হবি নি! আরে দু’জায়গায় ব্যবসা হলি বেচাকেনাটা একটু বেশি হয় বোঝেন না! ঘরে টাকা-পয়সার আকাল তো। আমি বলি, তুমি তো গাইন। গান গাইতে জানো? আরে, এইতো আপনার সামনে দায়ের ফলার গান করতেছি। মজবুত কাস্তের ধরনের ধারালো দা তার হাতে চলমান। জীবনের তাল কেটে গেছে গো! তাল ফালা করো আর কচি শাঁস হাতে ধরো। আমি বলি, জমি জিরেত আছে? প্রভাস বলে, ওসব নাই। অন্য সময় জন খাটি। মাটি হলো গিয়ে খাঁটি গো! কোনো সময় গাছুরে। গাছে উঠে ডাব পাড়ি, মাইনষের বাড়ির নারকোল সুপারি পেড়ে দি।

এবার রাস্তার ওপারে ছেলে বেটা প্রভাতের কাছে যাই। দেখি এক ঘোলওয়ালা মাথায় ঘোলের হাঁড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বলি, আপনার নাম? সে বলে, আমি দীননাথ। আমি ঘোল বিক্রি করি। ওরা ঘোল খায় আর শাঁস বেচে। যা গরম পড়েছে আমার ঠাণ্ডা ঘোল, তার উপরে বরফ দেওয়া । না খেলে এই রোদের ঠাঠা তাপে
ওদের শরীর জুড়বে কেমন করে?
প্রভাত বলে, আমি কিন্তু আসল গাইন। গাছ কাটতেও জানি, বাইতেও জানি, গান গাইতেও জানি। আমি অন্য সময়ে বাউল গান গাই।

রাম বারিক। সে আমাকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। খুলে সব বলতে চায় না। অতসব জিজ্ঞেস করেন কেন? বাবার নাম, আমার নাম। বউয়ের নামও জিজ্ঞেস করবেন নাকি? আমি হকচকিয়ে যাই। সে বলে, আমি মনসাতলা থাকি। হনুমান মন্দিরের কাছে। অতো নাম বলতে পারবো না! সেসব অনেক জায়গা থেকে সংগ্রহ করি।

সুদো পারমাণিক। নাম শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। সুদো আবার কারো নাম হয় নাকি! সুদো বলে, পৃথিবীতে মা আমারে নিয়ে এলো। কার কাছ থে ধারদেনা করে নিয়ে এলো! সে কর্জ শোধ করতে হবে না? মাকে তো আমার সুদ দিতে হবে গো! তাই বুঝি এই সুদ, ধার করার দায় মা আমারে দিয়ে গেল। তাই তো নাম রাখল সুদো। আরে এ যে দার্শনিক তত্ত্ব শেখায় আমাকে!
সে আমাকে পছন্দ করে। বলে, এসেই যখন পড়িছেন আগে চা খান। তবে আমার থেকে কথা কিনলে পরে ওই চায়ের দাম আপনাকেই দিতে হবে।
সে বলে, হরিণঘাটায় ওই যে হিজরা মৌজা সেখান থেকে আসি। নগরউখড়া, দত্তপাড়া, নিচপাড়া, গাইঘাটা, বামারদে পানপুর থেকে তালের কাঁদি সংগ্রহ করি। চা খেতে খেতে প্রশ্ন করি, একটা কাঁদিতে কত তাল থাকে? সে বলে মায়ের পেটে একটা দুটোই থাকতে পারে কাঁদিতে দশটা- বারোটা-পনেরটা থাকতি পারে।
অত দূর থেকে আসো কি করে? সে বলে, আসা-যাওয়া কি আর আমারদের হাতে গো? যে নিয়ে আসে সেই তো নিয়ে যায়। ওই দ্যাখেন আমার ভ্যান আর ওই কাছি দড়ি। আমি দেখি তার সেই ভ্যান আর নাইলনের হলুদ রঙের মোটকাছি দড়ি।
কুড়ি পঁচিশ তালের কাঁদি এই মোটা কাছি দিয়ে জুত কইরে বেঁধে ভ্যানে তুলি।
বিকেল পড়তি পড়তি মাল সব বিক্রি হয়ে যায়। এখন কুড়ি টাকায় চারটে বেচি।কখনো সখনো পাঁচটাও বেচি। শক্ত হয়ে গেলে শাঁসের দাম নিচে নেমে যায়। সাত আটটা কুড়ি টাকায় বেচে দি। জানেনই তো একটু শক্ত ডাঁটো হইলে জীবনের দাম বাড়ে, তালশাঁস শক্ত হইলে দাম কমে।
আজ একটু বেচাকেনা বেশি। গরম পড়িছে তো! কচি তালের শাঁস, তার বুকে ঠাণ্ডা জল মুখে দিলে বেশ লাগে!
অন্য সময় ডাব বেচি। কচি ডাবের জল খরিদ্দারে খেতে চায়। কেউ চায় একটু নরম শাঁসের কচি ডাবের জল। খাবার পর ডাবটি কেটে দুই ফালা করে দাও। বাবু ডাবের কচি শাঁস তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাবে। জল খাওয়া হলো আর শাঁসও চলে গেল মুখের ভেতরে। শাঁসেরও কচি বেলা যৌবন বেলা আছে গো!
আমি কলকাতাও যাই। গাঁটরি গাঁটরি ফুল দিয়ে আসি হাওড়ার নদীর এপারে ফুলবাজারে। আপনারা বলেন ফুলের মার্কেট।
এ জীবনটা তো ফুল আর ফলের জন্যিই। আপনি কি বলেন? জীবনটা হল শ্বাস আর শাঁসের। শাঁস না হইলে জীবনে শ্বাস চলে না, শ্বাস না থাকে তো শাঁস খাবেন কেমনে?

আমি একমাথা রোদ্দুর নিয়ে বাড়ি ফিরি। লাল কলার দেওয়া সাদা গেঞ্জিটি ততক্ষণে ঘামে ভিজে গেছে। কোথায় গিয়েছিলে, এত দেরি?
কবিতা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আরে শিগগির খুলে ফেলো গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে জ্যাবজ্যাবে হয়ে গেছে, ঠাণ্ডা লেগে যাবে তো!

শাঁস আর শ্বাস, ফুল আর ফুল…. বিড়বিড় উচ্চারণ স্নায়ুকেন্দ্রে আলোড়ন তুলে সংবেদন হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আমার ভেতরে!