অবতকের বিশেষ প্রতিবেদন

জ্যৈষ্ঠের শুক্লা ষষ্ঠী
সতীমার ডালিমতলা যখন ইচ্ছেপূরণতলা

তমাল সাহা

বিজ্ঞান চেতনাকে তছনছ করে দিয়ে কাকতালীয় ঘটনা ঘটে গেলে আমি কিছুক্ষণ শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। জ্যৈষ্ঠের শুক্লা ষষ্ঠীর বৃহস্পতিবারের এই মহিমাময়ী ভোরে কবিতার আর্তনাদ– হায়রে! মরে গেল। এই চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে যায়।
বাইরে বেরিয়ে দেখি উঠোনে পোষ্য বিড়াল ছানাটি অনিবার্য মৃত্যু হাতে নিয়ে দ্রুত হৃৎস্পন্দনে মরণ খেলা খেলছে। কদিন থেকেই দেখেছি আমার জাতকেরা যৌথ প্রচেষ্টায় তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ‌শেষ পর্যন্ত মরে গেল শাবকটি।

সেই ভোরে মরে যাবার পর বেলা ১১ টা নাগাদ একটু স্বাভাবিক হলো কবিতা। দীর্ঘশ্বাস পড়ল– আজকের দিনে মা ষষ্ঠীর বাহন মরে গেল চোখের সামনে!

স্নান সেরে শুদ্ধ হয়ে শুদ্ধ বস্ত্রে তখনও চুলে আর্দ্রতা মাখানো তার।কপালে লাল সিঁদুরের টিপ। আলতায় রাঙানো পা-দুটি। হাতে তালপাখা। পাখার উপর রাখা দুব্বো, কুরুল, করমচা আরেকটি আম। মা কবিতাকে শিখিয়েছিল এটাকে জামাই ষষ্ঠী বললেও এটা কোনো পার্বন বা উৎসব নয়। জামাই ষষ্ঠী এসব অনেক পুরনো কথা। এটা আসলে মাঙ্গলিক ব্রত। ব্রত শব্দটির মধ্যে বরদানের সম্পর্ক আছে। পশুপাখি প্রজা পালন করে মা ষষ্ঠী। বিড়াল তার বাহন। মা ষষ্ঠীর কৃপায় প্রজন্ম তৈরি হয় মানে বংশরক্ষা হয়। এমনই বলা হয়ে থাকে।

মা কবিতাকে বলেছিল, তালগাছ দীর্ঘজীবী। তালের প্রসারিত অথচ ভাঁজ করা পাতা দীর্ঘ জীবন ও সংগ্রামের প্রতীক। পাখার বাতাস শীতল। দুব্বো ঘাস চিরজীবী, বাঁশের কুরুল চিরহরিৎ যৌবনের প্রতীক। আম মানে বিশাল, অগণন‌। এগুলি সবই জীবনের উপাদান, সঠিকভাবে বাঁচার আয়োজন।
কবিতা বলে, মা! করমচা, হলুদ ডোর, মন্ত্রের কথা তো বললে না! মা বলে, করমচা তো জানিসই। নেবুর পাতা করমচা! এই বৃষ্টি থেমে যা। করমচা হলো ঔষধি ফল।

হৃদয় তো বোঝো! করমচা হৃৎস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে। হলুদ রং অনুভবের রং। হলুদ ডোর হাতে বাঁধলে বন্ধনের দৃঢ়তা বাড়। আর মন্ত্র তো একটাই– পাখার বাতাস দাও মানে সব বিপদ আপদ উড়িয়ে দাও আর মুখে বলো তিনবার ষাট! ষাট! ষাট! তিন ষাটে কত? ১৮০– তার মানে দীর্ঘায়ু ভব।
কবিতা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

কবিতা বলে, কাছে এসো, মঙ্গল কামনা করি। বরাভয় প্রদান করি। শুভেচ্ছা দান করি। তোমার মনে আছে মা কত কথা বলে গিয়েছিল ষষ্ঠীর বিষয়ে। এটা সার্বজনীন ব্রত, পারিবারিক সম্মিলনের অনুষ্ঠান। শ্বশুর গৃহ ও পিতৃ গৃহের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন। আসলে কন্যার স্বামীকে পুত্ররূপে কাছে টেনে নেওয়া। এটা একটা সান্নিধ্যের অনুষ্ঠান।
এইভাবে সমস্ত নারীরা কল্যাণময়ী হয়ে গেলে পৃথিবী সুখী হয়ে পড়ে।

তারপর দ্বিপ্রাহরিক রৌদ্র মাথায় করে চলে যাই আমার প্রিয়তম ডালিমতলা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের পাড়ায়। যারা জাত ধর্ম বর্ণ মানে না, মানুষকেই অারাধ্য বলে মনে করে। আউলিয়া সম্প্রদায়ের ফকির রূপে চৈতন্যদেব এখানে এসেছিলেন এমনই শ্রুতকথা। আমাদের সাহিত্যিকরা নবীনচন্দ্র সেন সমরেশ বসু সুব্রত মুখোপাধ্যায় যারা লেখায় পরিব্রজনকে প্রাধান্য দেন তারা সতীমার মেলা প্রত্যক্ষ করে গিয়েছেন।

সতীমাতার সাধনাপীঠ ডালিমতলা, ইচ্ছাপূরণ স্থান। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা তিথিতে মানুষ-মানুষী এখানে এসে পুজো দেয়। গর্ভাধানের জন্য নারীরা জীবনসঙ্গীকে নিয়ে মাকে প্রার্থনা জানিয়ে যায়। ডালিম গাছে লাল সুতো দিয়ে মাটির ঘোড়া, ইটের টুকরো বাঁধে মনোবাঞ্ছাপূরণের জন্য।

ডালিম গাছ আশ্চর্য গাছ। এও কি এক বোধিবৃক্ষ! দেখি অজস্র ডালিম ফল ঝুলে আছে। ডালিমতলা কেন? ডালিম বহুবর্ষজীবী ঔষধি গাছ। বিস্তৃত তার ডালপালা। ডালে ডালে ফল, তা থেকেই কী ডালিম? উপরে শক্ত আবরণ ভেতরে দানাময় লাল ফলের মহিমা। রসময় উজ্জ্বল ডালিম বোধ করি জীবনের প্রতীক। সংগ্রামী শক্ত আবরণের অন্তর্গত জীবনের রসের রক্তিম দানা। রক্ত তো জীবন প্রবাহ ঔজ্জ্বল্যের প্রতীক। ঘোড়া বাঁধে কেন? অশ্বগতির কথা কেনা জানে? অশ্ব তো জীবনের গতিময়তার অনুভব। ইটের টুকরোই বা বাঁধে কেন? খণ্ড এই জীবন টুকরো ইটের মতো। ভাটিতে পুড়িয়ে ইট তৈরি হয়। জীবনও পোড় খাইয়ে তৈরি করতে হয় রে পাগল!

ডালিম তলায় মানব সমাগম। ইচ্ছেপূরণতলায় মানুষ মনস্কামনা পূরণে পুজো দিচ্ছে।
এক দম্পতির হাসিমাখা অবয়ব দেখে আমার মন শুদ্ধ হয়ে গেল। ডালিমতলা থেকে সম্প্রচারিত আমার কথাগুলো তারা শুনছে। আমি বুমটি তাদের কাছে নিয়ে যাই। বলি তোমাদের মুখ এতো রহস্য মাখা কেন? কৃষ্ণা সুন্দরী নারীটি বলে,আমরা আপনার কথাগুলো শুনে অনেক কিছু শিখছি। নারীটি বলে, এই ডালিমতলাই ছিল আমাদের ছাদনাতলা। আমরা পালিয়ে বিয়ে করেছি। সতীমায়ের স্থানেই আমাদের দাম্পত্য জীবনের স্বীকৃতি ও পরিচর্যার সূচনা হয়েছিল। প্রতিবছর আমরা আসি। মনস্কামনা জানাই।
আমি জিজ্ঞেস করি, তোমাদের উত্তরাধিকার আছে? হ্যাঁ, ওই তো! ছুটে এসে বালকটি আমাকে প্রণাম করে। দম্পতিও ঝুঁকে পড়ে আমার পায়ের দিকে। আমি বাধা দান করি।

মানুষ, মনস্কামনা, প্রজন্ম, উত্তরাধিকার শব্দগুলি আমার স্নায়ুকোষে আবর্তিত হতে থাকে। চোখের সামনে দুলতে থাকে ডালিম ফল, লাল সুতোয় বাঁধা মাটির ঘোড়া ইটের টুকরো।
আমি দুধ পুকুরের দিকে হাঁটতে থাকি। ভাবি জীবন কী? জল মিশ্রিত দুধ না দুধ মিশ্রিত জল! জলে দুধ… দুধে জল…