কমিউনিস্ট কণ্ঠস্বরঃ
গীতা মুখার্জিকে নিয়ে হৈচৈ এবং কাঁচরাপাড়া কেন গর্বিত
তমাল সাহা

গীতা মুখার্জি একটি সাদামাটা নাম। এখন এই নাম নিয়ে সারা ভারতবর্ষ তোলপাড়। এই নামটি পার্লামেন্ট অফ ইন্ডিয়ায় এখন উল্লেখিত হচ্ছে বারংবার।
এই বাঙালি নারীই সাংসদ হিসেবে প্রথম চিন্তা করেছিলেন সমস্ত ভারতীয় নারীদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের অধিকারের কথা।ভারতবর্ষের মাটিতে যখন পুরুষতন্ত্রের দাপটের শেকড় গভীরভাবে গেড়ে বসেছে তখন তিনি মহিলা স্বার্থ সংরক্ষণে মহিলা সংরক্ষণ বিলের পক্ষে লড়াকু পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় সংসদে। দিনটা ছিল ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬। তখন দেবগৌড়া সরকারের শাসনকাল। যথার্থ ফেমিনিস্ট আন্দোলনের নেত্রী তিনি। কারণ তিনি কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। পুরুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে জন্মানো কোন নেতা যা করতে উদ্যোগী হননি তখন মেদিনীপুরের মাটির এই পিছাবনী নারীটি সোচ্চার হয়েছিলেন। এই মহিলা সংরক্ষণ বিল উত্থাপন– উল্লেখযোগ্যভাবে তাঁকে প্রচারের আলোকে নিয়ে আসে। উল্লেখ্য এই বিল ২০০০ সালে রাজ্যসভায় পাসও হয়ে যায়। কিন্তু সে সময় লোকসভায় পাশ করানো যায় নি।
ফাসিস্ত বিজেপি যখন মহিলা সংরক্ষণ বিলকে নারী শক্তি বন্দনা বিল নামকরণ করে তাকে ২০২৪ সালের নির্বাচনের ভোটপণ্য করতে চাইছে তখন বামপন্থীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন গীতা মুখার্জী। ভারতবর্ষের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে বামপন্থীরা সোচ্চারে বলতে পারছে প্রকৃতপক্ষে এই বিলের উদ্যোক্তা কমিউনিস্টরাই।

এই বিল নিয়ে আলোচনার জন্য তৎকালীন দেবগৌড়া সরকার বিলটি সংসদীয় সর্বদলীয় কমিটিতে পাঠিয়ে দেন। গীতা মুখার্জি ছিলেন সেই কমিটির চেয়ারপার্সন।
তিনি মহিলাদের পক্ষে অত্যন্ত দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন এবং সংরক্ষণ বিলে লড়াইয়ের সক্রিয় ভূমিকা নেবেন বলে পরবর্তীতে যখন ইন্দ্রকুমার গুজরাল মন্ত্রিসভা ক্ষমতায় আসে সেই সময় সেই সরকারে মন্ত্রী হবার প্রস্তাব তাঁর কাছে এলে তিনি তা সরাসরি উপেক্ষা করেন।
তিনি জনতার কাছে গীতা দি নামে পরিচিত ছিলেন।

সম্পূর্ণ রাজনৈতিক জল আবহাওয়ায় পরিপুষ্ট গীতা দি-র জীবন। তিনি ছিলেন সিপিআই নেতা ভারতবর্ষের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের কনিষ্ঠ সহোদরা এবং কমিউনিস্ট নেতা বিশ্বনাথ মুখার্জির সহযোদ্ধা সহধর্মিণী। আর স্বাধীন তাম্রলিপ্ত সরকার গঠনের উল্লেখযোগ্য নায়ক, পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসি অপশাসনের মূল কারিগর অজয় মুখার্জি ছিলেন তাঁর ভ্রাতাশ্বশুর। এই অজয় মুখার্জি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।
গীতা মুখার্জী ১৯৬৭ –১৯৭৭ পূর্ব পাশকুড়া থেকে নির্বাচিত চারবারের বিধানসভা প্রতিনিধি এবং ১৯৮০–২০০০ সাল পর্যন্ত সাতবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাড়ে পাঁচ দশক তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের জীবন। তিনি এতই সাধারণ জীবন যাপন করতেন যে কলকাতা থেকে দিল্লী সাধারণ থ্রি টায়ার স্লিপার কামরায় ভ্রমণ করতেন।

বার্লিন মহিলা আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক ফেডারেশন সচিবালয়ের সদস্য, মহিলা জাতীয় কমিশন, জাতীয় শিশু বোর্ড এবং জাতীয় মহিলা ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি।

কাঁচরাপাড়া কিছুতেই তাঁর কথা ভুলতে পারেনা। তিনি বারবার কাঁচরাপাড়ায় এসেছেন রাজনৈতিক কারণে।
চোখে সেকেলে চশমা, পরনে সাদা মাটা শাড়ি, পায়ে স্লিপার কখনো বা কেডস এই ছিল তাঁর পরিধেয় সম্বল।

বিনা বিচারে ছ মাস জেল খাটা, ১৯৪৮ সালে ব্যানড কমিউনিস্ট পার্টির তিন বছর আন্ডার গ্রাউন্ডিস্ট সেই গীতা মুখার্জি ১৯৪৬ সালে গণপরিষদের নির্বাচনকালে বেঙ্গল আসাম রেলওয়ে কেন্দ্রে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী জ্যোতি বসুর পক্ষে ছাত্র কমরেডদের নিয়ে কাঁচরাপাড়া রেল কলোনিতে ঘুরে ঘুরে প্রচার করেছিলেন।

১৯৬৩ সালে মহিলা সমাবেশে সতীশ নন্দী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি বক্তব্য রাখেন।১৯৬৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআই সমর্থিত বলশেভিক পার্টির বীজপুরের প্রার্থী নেপাল ভট্টাচার্যের সমর্থনে ব্রতচারী পার্কের জনসভায় যখন বক্তৃতা করছেন তাঁর সহযোদ্ধা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় তখন মিলননগরের অনুষ্ঠিত জনসভায় সেই প্রার্থীর সমর্থনে দুর্দান্ত জনভাষ্য রচনা করে চলেছেন গীতা মুখার্জী।

মনে পড়ে ১৯৬৯ সালে স্টোরব্লক-ভূজবাগান কলোনিতে কিছু দুষ্কৃতীর বোমাবাজিতে পুলিশের গাড়ি পুরোপুরি উল্টে যায়। প্রাদেশিক দাঙ্গা বেঁধে যাবার উপক্রম হয়। খবর পাওয়া মাত্র গীতা মুখার্জি কলকাতা থেকে সদলে ছুটি আসেন কাঁচরাপাড়ায়। ঘটনাস্থলে উত্তেজনা প্রশমনের কাজে নেমে পড়েন।
ত্রয়োদশ লোকসভা নির্বাচনে বারাকপুরে বামফ্রন্ট প্রার্থী তড়িৎবরণ তোপদারের সমর্থনে ক্রেগ পার্কে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় জনসভায় বক্তব্য রেখে বিজপুরের সাথে শেষ সাক্ষাৎ করে চলে গিয়েছিলেন গীতাদি।

তিনি জন্মেছিলেন ৮ জানুয়ারি, ১৯২৪ সাল। সেই অনন্যা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন ৪ মার্চ ২০০০।

তাঁর মৃত্যুতে শোকবিহ্বল হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি।
তিনি বলেন, মিসেস মুখার্জি দৃঢ় সংকল্প এবং উৎসর্গের মূর্ত প্রতীক। তিনি ছিলেন নারীর ক্ষমতায়ণের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তাঁর জীবন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বিশেষ করে নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে‌।