আজ ২ জুন আন্তর্জাতিক যৌনকর্মী দিবস

এখনো যদি এ লেখা না লিখি আমার হবে পাপ। আজীবন বর্ষিত হবে আমার মাথায় তোমাদের অভিশাপ।

কাছে এসো স্বৈরিণী, তোমার পায়ে মাথা রাখি
তমাল সাহা

পরাধীনতার কৃষ্ণপক্ষ আর কত ঘন হতে পারে এই বঙ্গোপসাগর তীরে যখন পতিতা মায়েদের উত্থান ঘটে দেশপ্রেমের চেতনায়, তারা তখন বারাঙ্গনা থেকে বীরাঙ্গনা হয়ে দাঁড়ায়?

বিডন স্কোয়ারের জনসভায় সেই কবে ১৯০৭ সালে পুলিশি লাঠিচার্জের প্রতিবাদে চিৎপুরের বাড়ির ঝুল বারান্দা ছাদে সমাবেশ ঘটিয়ে কারা ইট পাথরের ঢেলা বর্ষণ করে তাড়িয়েছিল ব্রিটিশ লাল মুখোদের, মনে পড়ে?
তারাই তো বিশেষরূপিনী বেশ্যাজননী।
সেটা ছিল অনুশীলন সমিতির বৈপ্লবিক সমাবেশ আর বক্তা কে? ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়।

সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, বেশ্যালয়ের মতো বিশাল ছায়ার আশ্রয় আর নেই। সে আশ্রয় এক বিস্তৃত মহীরুহের আশ্রয়। পতিতারাই বিপ্লবীদের সুনিশ্চিত নিরাপত্তা দিতে পারে আর দিতে পারে বিপ্লবীদের খবরের যোগান। পুলিশের গতিবিধি খানা তল্লাশির আগাম সংবাদ। কত পতিতা বিপ্লবীদের হাতে তুলে দিয়েছে অর্থ এবং অলংকার।

চিৎপুরের পতিতালয়ের সেই সুন্দরী বিমলা ছিলেন গণিকা না গণধাত্রী, আমাকে বিস্মিত করে। ইতিহাস বলে তিনি গণিতাবৃত্তি পরিত্যাগ করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সুশিক্ষিতা। বাংলা ইংরেজি সমানে বলতে পারতেন। ব্রিটিশ বিরোধী এক সভায় ইংরেজিতে তিনি কি বলেছিলেন? সেইবার যখন মাউন্টপুলিশ জনতার ভিড়ে ঘোড়া ছুটিয়ে সমাবেশ ভেস্তে দিয়েছিল, পতিতা বিমলা জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতায় বলেন–তুমি কি মাতৃগর্ভে জন্মাওনি হে পুলিশ? তুমি কি করে জননী ভগিনীদের গায়ে হাত তোলো? Are you not born of a woman? How do you beat your mothers and sisters?
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই বারাঙ্গনার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন, এমনই জানা যায়।
শরৎচন্দ্রের পথের দাবীতে সুমিত্রা কে? বিমলাই কি হয়ে উঠল সুমিত্রা অথবা সুমিত্রাই হয়ে উঠল কি বিমলা? কাকে বলো তুমি বল দেহোপজীবা?

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের অগ্নিহোত্রী অর্ধেন্দু দস্তিদার। সেই জখমি যোদ্ধাকে যখন আর বাঁচানো গেল না, তিনি শহীদ হলেন তখন শ্মশানে গিয়েছিলেন কারা?
বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘মুক্তি সংগ্রামে অন্তঃপুরবাসিনী ও বারাঙ্গনা’ নিবন্ধ থেকে জানা যায়, শ্মশানের কাছে থেমেছিল একটি ঘোড়ার গাড়ি। চারজন গণিকা শহীদের পদযুগল দুগ্ধে স্নান করিয়ে দিয়েছিলেন আর তারপর নিবেদন করেছিলেন পুষ্পার্ঘ্য। তুমি এঁদের কি বলবে পতিতা না নিবেদিতা?
স্বাধীনতা সংগ্রামে পতিতাদের অবদান নেই?

সেটা ১৯২৪ সাল। স্থান তারকেশ্বর। উল্লেখযোগ্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন সংঘটিত হল। সেখানে মুখ্য ভূমিকায় আন্দোলনের প্রথম সারিতে আমার ভালোবাসার রূপাজীবীরা। নেতৃত্বে দিয়েছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ।

সোনাগাছি অপূর্ব এক নাম। ভদ্রবাবুরা বলেন পতিতা পল্লী, অভদ্রজনেরা বলেন বেশ্যাপাড়া। সেখানেও লেখিকারা থাকেন। মহান মহান সব লেখালিখি।
হাড়কাটা গলির বেশ্যা মানদা দেবী রামবাগান বেশ্যাপল্লীতে হয়ে ওঠেন ফিরোজা বিবি আর সোনাগাছিতে হয়ে যান মিস মুখার্জি।

বারবনিতা সুশিক্ষিতা মানদা দেবী যখন ‘শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত’ লেখেন, তাতে লেখেন পতিতাদের রাজনৈতিক সচেতনতা ও উন্মাদনার কথা তখন তারা অগ্নিশুদ্ধা মহীয়সী নারীরূপে উঠে আসেন আমার কাছে। ঐতিহাসিক বইটি বহু প্রশংসিত। এর চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বইটির ‘অগ্নিক্রীড়া’ পরিচ্ছদে তিনি পতিতাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশগ্রহণের কথা বিশদে লেখেন।

তারা চিত্তরঞ্জন দাশের নারী মন্দির প্রতিষ্ঠায় কিভাবে দলবদ্ধ হয়েছিলেন, কিভাবে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বাসন্তী দেবী, সুনীতি দেবী, সন্তোষ কুমারী দাশগুপ্তা, মোহিনী দেবী, হেমপ্রভা মজুমদার, বগলা সোম, উমা দেবীর সান্নিধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রামের অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় হয়েছিলেন, পিকেটিং করেছিলেন, ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার বরণ করেছিলেন তা বিস্তৃত উল্লেখ করেছেন।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের শেষযাত্রায় ‌ পতিতাদের ছিল উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি।
মানদা দেবী লেখেন দার্শনিক অশ্বিনীকুমার দত্তের নেতৃত্বেই বরিশালের উল্লেখযোগ্য বেশ্যা সমিতি পতিতাদের সংঘ গড়ে উঠেছিল। অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে বরিশালের পতিতারা চরকায় সুতো কাটতেন। তাদের পরিধানে ছিল খদ্দরের শাড়ি। উৎসাহিত হয়ে তিনিও তার পতিতালয়ে একটি চরকা কিনে সুতো কাটতেন এবং খদ্দরের শাড়ি ও ব্লাউজ পরিধান শুরু করেছিলেন।

সেই সময় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে গড়ে উঠল বন্যার্ত রিলিফ আন্দোলন। পতিতারা এগিয়ে গেলেন অভিযানে।
হাড়কাটা গলি, রামবাগান, সোনাগাছি, চাঁপাতলা, আহিরীটোলা, জোড়াসাঁকো সিমলা, কেরানি বাগান পল্লীর পতিতারা সঙ্ঘবদ্ধ হলেন। অর্থ সংগ্রহ অভিযান সে এক অনুপম দৃশ্য ! গেরুয়া রঙের লাল পেড়ে শাড়ি পরিধানে, কপালে সিঁদুর ,পিঠে ছড়ানো এলোচুল, কণ্ঠে সংগীত, মনোহারিণী বিভঙ্গে চলমান যাত্রা। মানদা দেবী লিখছেন, ‘কয়েকজন পুরুষ ক্ল্যারিয়নেট ও হারমোনিয়াম বাজাইতেছে। অগ্রে অগ্রে দুইটি নারী একখানি শালুর নিশান ধরিয়া যায়, তাতে কোন্ পাড়ার পতিতা নারী সমিতি তাহা লিখিত আছে। তাহার পশ্চাতে অপর দুই নারী একখানি কাপড় ধরিয়াছে, তাহাতে দাতাগণ টাকা পয়সা নোট প্রভৃতি ফেলিয়া দিতেছে।’
জানা যায় লক্ষাধিক টাকার সংগ্রহ তারা সম্পূর্ণভাবে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। আচার্য কি বলেছিলেন? এসো, এসো মা লক্ষ্মীরা, বসো! এঁরা কি করে রাঢ় মাগী হয়?

মেদিনীপুরের মাটি তো দুর্জয় ঘাঁটি। মাতঙ্গিনী হাঁটে। তবে কি সেখানকার বারনন্দিনীরা ঘরে চুপ করে বসে থাকে? নিজেদের শরীরের সওদা করে?
সত্যবতী! বেশ্যাদের এমন নাম হতে পারে? এইসব নাম দেখে আমি বিপন্ন বিস্ময় বোধ করি। যে নারী দেহ বেচে খায় সে নন্দীগ্রামের সত্যবতী, সোনাগাছির মানদা! এসব কেমন করে হয়?

মেদিনীপুরে বয়ে চলে দেশপ্রেমের উত্তপ্ত বাতাস। সত্যবতীর কি মনে পড়ে ক্ষুদিরামের মুখ?
তাহলে এখন কি করবে সত্যবতী?
সেটা লবণ আইন অমান্য আন্দোলনের সময়। সেই আন্দোলনে ভিড়ে গেলেন সত্যবতী। পিকেটিং আন্দোলনে পতিতা গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন,১১ জানুয়ারি,১৯৩০। তিন মাস পর জেল থেকে মুক্তি পেলে কি হবে তখন তো রাজনৈতিক চেতনার শেকড় চারিয়ে গেছে বুকের অনেক গভীরে। নন্দীগ্রামের এক রাজনৈতিক সভায় আবার ধরা পড়লেন সত্যবতী, ১৯ আগস্ট। শুরু হলো পুলিশের নৃশংস অত্যাচার। বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত শরীর মরে গেলেন। অজানা অবহলিতা শহীদ সত্যবতী।

তমলুক। ৪২ এর আন্দোলন চলছে। ১৪৪ ধারা জারি। ম্যাজিস্ট্রেট পেডি সাহেব সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে এক ব্রিটিশ বিরোধী সমাবেশে বাধা দিলেন। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলি। রুদ্র মূর্তি নিয়ে রুখে দাঁড়ালেন এক রূপসী গণিকা সাবিত্রী দেবী। তিনি বললেন, সভা হবেই। রক্ত দেবো। তবু পিছু হটবো না।

বিপ্লবকে ভালোবাসলে নারী কতদূর যেতে পারে? স্বৈরিণী না হলেও সহবাসে যেতে পারে।
নারী সৌদামিনী গাঙ্গুলী আর বিপ্লবী শশধর আচার্য স্বামী-স্ত্রী সেজে সংসার পেতে ছিলেন চন্দননগরের এক বাড়িতে। মঞ্চেই কি শুধু নাটক হয়, দেশপ্রেমের আসল নাটক তো লেখা হয় যাপিত সংসারে!
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সেই ইতিহাস। জালালাবাদ পাহাড়ে যুদ্ধের পর এই বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন বিপ্লবী অনন্ত সিং গণেশ ঘোষ লোকনাথ বল এবং জীবন ঘোষাল। চন্দননগরের সেই বাড়ি ঘিরে ফেলল সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী নিয়ে চার্লস টেগার্ট। শুরু হলো আগ্নেয় যুদ্ধ। যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান জীবন ঘোষাল। ধরা পড়ে গেলেন শশধর আচার্য ও সুহাসিনী। শারীরিক নির্যাতন করেছিল চার্লস টেগার্ট সুহাসিনীকে। ২৩ মার্চ, ১৯৫৬ সালে স্বাধীন ভারতবর্ষে সুহাসিনী প্রয়াত হয়েছেন। সহবাসিনী সুহাসিনীকে কি আমাদের মনে আছে?

স্বাধীনতা মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস তো বারাঙ্গনাদের বারবনিতাদের ইতিহাস। সেই সিপাহী বিদ্রোহের আমল থেকে শুরু পতিতাদের আত্মত্যাগ। আজিজুন বাঈয়ের কথা মনে পড়ে। নানা সাহেবের আমলে পুরুষবেশী যোদ্ধা ছিলেন সেই বাঈজী। মনে পড়ে মানকুমারী, আশা দেবী, বহিমা, হাবিবা কতসব দলিত পতিতা নারীদের কথা। তাদের তো অনেকেরই মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল, কাউকে বা আগুনে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল।

জানা অজানা স্মরণীয় স্বৈরিণীরা দখল করে রাখে স্মৃতির সরণি। কোথায় স্বৈরিণী! মুক্তির দিশা দেখায় রম্যাণি রমণী।

ছবিঃ মানদা দেবী