আজ ৫ আগস্ট কমিউনিস্ট চিন্তাধারার নায়ক মুজফফর আহমদের জন্মদিন

কমরেড, কমিউনিস্ট, কয়েদি এক হয়ে যায়।পরাধীনতা থেকে মুক্তিতে শ্রমজীবী বাতাস কেঁপে ওঠে। লেখে ইতিহাস। ২৫ হাজার মেহনতির কড়াপরা হাত বজ্রমুষ্ঠি তোলে, স্লোগান ওঠে পূর্ণ স্বাধীনতা চাই। ১৯২৮ সাল কংগ্রেস সম্মেলনে কেঁপে উঠেছিল এই উচ্চারণ কলকাতায়। শ্রমিক জাগরণ ছাড়া মুক্তি আসে নাকি!সময় কাকে দেবে ফাঁকি?

১৯২৯ সাল মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা। স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের বৈপ্লবিক অধ্যায়। কারা কারা গ্রেপ্তার হয়েছিল কমরেড হওয়ার অপরাধে? ৩৩ জনের মধ্যে অন্যতম ছিলে তুমি। গান্ধীজীর মতো অহিংসবাদী নেতা এই উত্থানকে সমর্থন করেছিলেন। পাশে ছিল জহরলাল নেহেরুও। সেই তুমি জেলে কাটিয়েছ জীবনের ২০টি বছর। কমিউনিস্ট! ১৯৩৪ সাল কমিউনিস্টদের কার্যকলাপ বৃদ্ধির কারণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভীত। মনে পড়ে সেই দুইটি কালা-কানুন–শিল্প বিরোধী বিল ও জন নিরাপত্তা বিল জারি করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। কমিউনিস্ট আবহাওয়ার পরিবেশ বিপর্যস্ত করতে এই সন্ত্রাসী আইন জারি হয়েছিল। অভিযুক্ত কমিউনিস্টরা কাঠগড়াকে বেছে নিলেন প্রচারের মঞ্চ হিসেবে। পার্টির সংগঠনের বিস্তারের এক কৌশল। প্রকাশিত হলো– ‘কমিউনিস্ট চ্যালেঞ্জ ইমিপিয়েলিজম ফ্রম দি ডক’। বইটির মুখবন্ধ লিখলে তুমি কাকাবাবু মুজফ্ফর আহমদ। আর সেই বিদ্রোহী কবি নজরুল, তোমার সঙ্গে তার সখ্য ছিল,ছিল সাহসী উচ্চারণ। তোমার সান্নিধ্যেই নিশ্চিত নজরুল হয়ে উঠতে পেরেছিল বিদ্রোহী নজরুল যে ছিল রাষ্ট্রীয় শোষণের বিরুদ্ধে,কৃষক এবং শ্রমিকদের পক্ষে। এই নজরুলই ইন্টার ন্যাশনাল-এর বঙ্গানুবাদ করেছিল, সেই নজরুল ও তুমি কাঁচরাপাড়া এসেছো। কাঁচরাপাড়া লিখে রাখে সেইসব রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস।

একদা একদিন সেই কাকাবাবু মুজফ্ফর আহমদ কাঁচরাপাড়ায় এসেছিলেন।

ধ্রুব ‘ক’ দেখলেই কেঁদে ফেলতো। মনে পড়ে যেত তার কৃষ্ণকে। আর আমার ‘ক’ দেখলেই কেঁপে ওঠে স্মৃতিভার কমিউনিস্ট পার্টি, কাকাবাবু, কাজি নজরুল আর কাঁচরাপাড়াকে মনে পড়ে।

কারখানা, কামগার, কমরেড

শব্দগুলি জড়ো হতে থাকে বুকের উঠোনে।

কামিনদের গেট পেরিয়ে বাইরে বেরোনোর দৃশ্য,

সাইরেনের ভোঁ, শ্রমিকদের সংলাপ– কারখানার এসব পুরোনো ছবির সঙ্গে আমি মিল খুঁজে পাই ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’- এর কারখানার বর্ণিল ভাষাচিত্রের।

আর ইস্তেহার, ম্যানিফেস্টো

দারুণ এক রক্ত দাপানো শব্দ– উত্তেজনায় কেঁপে যায় আমার শরীর।

এই কারখানায়ও একদিন হ্যান্ডবিল বিলি হতো।এখানে শ্রমিক বেল্টে অনেকবার এসেছেন কাকাবাবু– মুজফফর আহমদ।

জ্যোতিবাবু, নিত্যানন্দ চৌধুরী, কাকাবাবু একসাথে দাওয়ায় বসে ভাত খেয়েছিলেন এই স্টোর ব্লকের ৩২৬ নম্বর কোয়ার্টারে দাশ বাড়িতে।

কাকাবাবু ও কবি দুজনকেই কতো কাছে পেয়েছে কাঁচরাপাড়া। দুজনে যেমন ঘনিষ্ঠ ছিলেন, দুজনে তেমন ঘন হয়েছেন এই সামান্য জনপদে।

কাকাবাবু মানে মুজফফর আহমদ, কবি মানে কাজি নজরুলের কথা বলছি।

অনেকবার কাকাবাবু এসেছেন কমিউনিস্ট পার্টির কাজে কাঁচরাপাড়ায়।

সিদ্ধেশ্বরী লেনের চ্যাটার্জি বাড়িতে আমরা ছোটবেলায় কাকাবাবুকে দেখেছি– একথা যখন কেউ বলেন তখন মনে হয় তার মনের ভাবখানা সেই টুনটুনি পাখির মতো।এখনকার বড় বড় কমরেডদের ঘরেও সেই স্মৃতির ধন নেই।

সেটা ১৯৫৪ সাল। বীজপুরের প্রথম বিধায়ক রিভলবার মাস্টার বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি অকালে প্রয়াত হয়েছেন। সেই প্রেক্ষিতে

বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।সেই সময় স্টোর ব্লকে বক্তৃতা দিয়ে গেছেন কমরেড ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত। কোনো হিন্দিভাষী ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষই বেরোননি বক্তৃতা শুনতে। তবুও তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন।

কয়েকদিন পর প্রচারে এলেন তখনকার জেলা সম্পাদক নিত্যানন্দ চৌধুরী, কাকাবাবু ও জ্যোতি বসু।

দাসবাবুর আস্তানা তখনো স্টোর ব্লকের ৩২৬ নম্বর কোয়ার্টারে। তারা খাওয়া দাওয়া সারছেন সেই কোয়ার্টারে। কথায় কথায় ইন্দ্রজিৎ গুপ্তর মিটিং-এর প্রসঙ্গ উঠলো। দাসবাবু বললেন, ‘নেড়ে’ আর ‘মেড়ো’দের বিশ্বাস নেই। দাসবাবুর মুখে এমন সাম্প্রদায়িক ও প্রাদেশিক উচ্চারণ শুনে ভাতের গ্রাস আটকে গেলো জ্যোতি বসুর মুখে। তার ওপর পাশেই বসে খাচ্ছেন কাকাবাবু। এটা পাঠকবর্গ সকলেই বুঝতে পারছেন নেড়ে আর মেড়ো বলতে কি বোঝাতে চাইছিলেন দাসবাবু।

নিত্যানন্দ চৌধুরী তখন জেলা সম্পাদক। সবই বুঝলেন। তিনি বললেন, বাস্তব অভিজ্ঞতায় যা বুঝেছেন তাই বলেছেন দাসবাবু। তিনি সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বা প্রাদেশিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ওসব বলেননি। মিটিং-এ মুসলিম আর হিন্দিভাষীদের জমায়েত না দেখে পার্টিকে জেতাবার স্বার্থেই নিজস্ব স্বপ্ন চুরমার হওয়াতে এ কথা বলে ফেলেছেন।

কাকাবাবুও তারিয়ে তারিয়ে সে কথা উপভোগ করছিলেন। সবাই ভেবেছিলো মেড়ো এবং নেড়ে শব্দ দুটি শুনে কাকাবাবু ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, বাস্তব অভিজ্ঞতার কথাই তো বলেছেন দাসবাবু। হিন্দিভাষী ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনও আমাদের পার্টি এ অঞ্চলে প্রভাব ফেলতে পারে নি। এ তো সত্যি কথাই।

তখন শিবদাসপুর ও হাজিনগর ছিল বীজপুর বিধানসভার অন্তর্গত। হিসাবে দেখা গেছে ওই দুই অঞ্চলে কমিউনিস্টরা তখনও পাল্লা ভারি করে উঠতে পারেনি।

কাকাবাবু! ঘন ঘন নির্বাচন হবে। কিন্তু সাদাসিধে বাস্তববাদী কাকাবাবুদের আর পাওয়া যাবেনা। কোনোদিন এই অদ্ভুত কাঁচরাপাড়া ক্যালানে ষষ্ঠীর মতো সেসব স্মরণ করে তাকিয়ে থাকবে আকাশের দিকে।

এখনও আজও কতো গোপনে জনতাকে না জানিয়ে জননেতা কাকাবাবুর জন্মদিন দায়সারা ভাবে পালন করা হয় ! এটা কি বাম- সুলক্ষণ?

এই হচ্ছে আমাদের বামচেতনা, আমাদের কমিউনিস্ট পার্টি, ইন্ডিয়ান!

হায়! শহরের কেউ কি জানে এমন একটা মানুষ এসেছিল কাঁচরাপাড়াতে! এই কারখানায় ঘুরে বেড়িয়েছে, মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক রচনা করেছে, কামগারদের সঙ্গে থেকেছে!

তা কি জানলো! তা কি জানলো! তা কি জানলো!