এখনো মানুষ আছে
ছুটছে ঝড়ো বাতাস
তমাল সাহা

আকাশে ঝুলে আছে বুদ্ধ পূর্ণিমার গোল চাঁদ। তবুও মেঘে ঢেকেছে আকাশ। গুরু গুরু শব্দে বেজে ওঠে ডম্বরু।

অন্ধকার ভেদ করে ঝড়ের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছুটছে বাতাস। নিচে সমুদ্র প্লাবনে তৈরি হচ্ছে বিশাল ঘূর্ণিঝড়। কোথাকার জল কোথায় যায়, কত দূর যাবে আমি কি জানি?

বঙ্গোপসাগরীয় মানুষ আগে স্পষ্ট করে বলো, তুমি কি দেখবে , জীবনের পদ্য গদ্য না প্রবন্ধ?

রাত্রির ঘনতর অন্ধকারে তুমি কি দেখো তুমি? দেখবে আর কি? তুমি তো শুধু অন্ধকারই দেখো। সুন্দরবনে বেড়াতে গিয়ে তুমি শুনেছ সুঁদুরি গরান গেওয়া কত সব বৃক্ষ।
আরো এক শব্দ শুনেছ তুমি লবণাম্বু উদ্ভিদ– ম্যানগ্রোভ। এই ম্যানগ্রোভ শব্দটিই আসল। এর থেকে তুমি শিখেছ একটু কাছাকাছি উচ্চারণ, ম্যান গ্রেভ– মানব সমাধি।

মানুষ মরে গেলে নাকি মানব থেকে যায়!
অসহায় নিরুপায় দুর্গত বিপন্ন শুকনো কান্নার জল— শব্দগুলি অভিধান থেকে উঠে আসে, কে বা কারা বানায়? ঘুরে বেড়ায় নোনা বঙ্গোপসাগরীয় হাওয়ায়।

নামগুলি শোনো আর দেখো।গোসাবার আরামপুর—
আর কত কত বছর স্বাধীনতার অপমান।
মানুষ লাইনে দাঁড়ায়, পেটে রেখে হাত, চায় ত্রাণ।
পাথরপ্রতিমা শুনেছো তুমি! প্রতিমা পাথরের নিঃশব্দ প্রাণ, তবুও মরণ খিদে তার,চোখে জল, বাঁচার আকুতি।
তুমি শুনেছ কুয়েমুড়ি গ্রাম। বাবু, ধরি তোর পায়ে। সব গিয়েছে ভেসে। দুটো খেতে চাই, দে দুমুঠো ভাত! তোকে সেলাম।

নৌকো তো নদীতে থাকে। উঠে এসেছে ওই যে খেজুরি তোমাদের প্রিয় চেনা নাম, তার উঠোনে। চারিদিকে জল আর জল! শুধু যোগাযোগের জন্য সাঁকো তৈরি হয়েছে কোন রকমে ইউক্যালিপটাস গাছের ডালে। এখানে তারা গাছের কুল ও খেজুর খেয়ে বেঁচে আছে। আর পানীয় জল! সে তো অনেক দূরে। পুকুরে ভেসে বেড়ায় ঝড়ে পড়ে যাওয়া গাছের লাশ। গাছগুলি পচে জলের পুরো সর্বনাশ। দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে আশেপাশে।

খিচুড়ি! যত পারো জলের মতো পাতলা করো।বানাও হলহলে খিচুড়ি। মুখ তো একটি নয়, অগণন সারি সারি। স্বেচ্ছাসেবীরা কি আর করে? তাদের সাধ্যমতো যত পারে দ্রুত ছুটছে রণপায়ে এক গাঁ থেকে আরেক গাঁয়ে। ‘আরো একটু দিন না, দিন! এইটুকুতে কি পেট ভরে!’ হাতজোড় করে বলে,’কেন যে জন্ম হলো মানুষের ঘরে?’

ভেসে গেছে গ্রাম, ভেসে গেছে ঘর ঘোড়ামারায়।নৌকোয় মানুষগুলি হা-মুখ, বাচ্চারা শুধু শাকপাতা চিবিয়ে খায়।

পানীয় জল কোথায়! আমি খুঁজি পশ্চিমবঙ্গ কোথায়? হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ বিজ্ঞাপন দেবো নাকি, সংবাদপত্রের পাতায়?
শাসন আর প্রশাসনে তফাৎ খুঁজি, মাথা ঘুরে যায়।

কুয়েমুড়ি গ্রামে ছ’হাজার মানুষ, একটি নলকূপ। তাও আবার চলে গেছে জলের তলায়!
শুনে তোমার জল চেষ্টা পেলো কি খুব!

বানভাসি, দুর্গত, উদ্বাস্তু, ভিটেহারা— কত শব্দের বাহার! সবারই শুকনো মুখে আঁকা ছবি, কোথায় খাবার! কোথায় খাবার! জমি-জিরেতে ঢুকেছে নোনাজল। কোথায় সবজি, কোথায় ফসল?
লক্ষ লক্ষ পচা মাছের গন্ধ বাতাসে।
কে যেন বলে, শুকনো করো, ফ্রাই করো কোনোদিন তুলে দেবে মুখের গ্রাসে।
গ্রামের অর্থনীতি বাঁচানোর কত উপায় আমি জানি, আরো জানা আছে।
এদিকে সংবাদ এসেছে, প্রিয় আনন্দ দিয়েছে, ত্রাণের দশ বস্তা চাল, ত্রিপল পার্টিকর্মীর ঘরে ঢুকে গিয়েছে।

ঘোড়ামারা দ্বীপের পেটের অসুখ এখন। চলছে স্যালাইন। হড়হড়ে বমি আর ঘনঘন হাগু, উজাড় গ্রাম। এই দেশ, বঙ্গপ্রদেশ তার নাম।

গোসাবা,রাঙাবেলিয়া- মানুষ আরো মানুষ আছে নাকি! চিড়ে গুড় মুড়ি জলের পাউচ নিয়ে কাড়াকাড়ি। মানুষ জীবন ভালোবাসে। আমার নিজের বাঁচা বড় দরকার। সুতরাং সে বাড়িয়ে দেয় নিজের লম্বা হাত তাড়াতাড়ি।

নামখানায় ছাগল নিজেকে বাঁচাতে উঠে গেছে ঘরের চালায়। গবাদি পশুর চোখে গড়াচ্ছে জল। মানুষ তো আছে মানুষের পাশে। পশুদের খাবারের কি সংস্থান হলো, কে জানে?

বিস্কুট! বিস্কুট! বিস্কুট! এসেছে বিস্কুটের টিন।
রটে যায় গ্রামে, এসেছে যেন আলাদিন!
শত শত শিশু হামলে পড়ে,’আমাকে দিন! আমাকে দিন! আমাকে দিন! আমি কিছুই পাই নি, আমাকে দিন!’
দিন! দিন! এতো আর্তরব, তবুও পাল্টায় না দিন।
অদ্ভুত, এই দেশ! এতো হা- পিত্যেশ! দশ মিনিটে ফুরুত! ফাঁকা হয়ে গেল কুড়িটি বিস্কুটের টিন! দাতার চোখে জল এসে যায়, শুধু শিশুগুলির মুখের দিকে তাকায়!
ওদিকে একদল স্বেচ্ছাসেবী মেয়ে,চলে গেছে একটু দূরে।
বয়ঃসন্ধির মেয়েরা কাচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তারা নিয়েছে দায়, বিলি করে যায় স্যানিটারি ন্যাপকিন।

পূর্ণিমার আলোয় ভেসে যায় আকাশের চন্দ্রমা।
সমুদ্রের বুকে নোনা জল খেয়ে টালমাটাল চাঁদ ভাসে আর ডোবে।
তথাগত! তুমি সন্ন্যাসী, ছেড়ে দিয়েছো রাজ।
চেয়ে দেখো কি অপূর্ব মানব সমাজ!

খাবার-দাবার সব ত্রাণ ক’দিনের মধ্যে পৌঁছে যাবে, বলছে প্রশাসন।
মধ্যবর্তী এ কদিন অনাহারী মানুষ কি খাবে?
মৃত্যুকে করবে আবাহন?
এ সব প্রশ্নের কোন জবাব নেই। কে দেবে জবাব?
কে খুঁজবে কারণ?
রাষ্ট্রদ্রোহীর মতো কেন করো আচরণ?
এখন চুপ থাকো, কথা বলা একদম বারণ।

চাই না এনআরসি
চাইনা গেরুয়া
এবার জোর গলায় তোলো স্লোগান—
বছর বছর চাইনা ত্রাণ, চাই পরিত্রাণ!

তবুও অন্ধকারে চাঁদটি জ্বলে
নিচে মানুষ জেগে ওঠে,
জেগে থাকে বাঁচানোর কোলাহলে।
কোথা থেকে দৌড়ে আসে আশ্বাস
বাতাস ধরে রাখে মানুষের শ্বাস প্রশ্বাস।
চোখে ভেসে ওঠে
সেই সব তারুণ্যে ভরপুর মুখগুলি
চিড়ে মুড়ি বিস্কুট জল মাস্ক স্যানিটাইজার নিয়ে দ্রুত চলে গেছে হিঙ্গলগঞ্জ নামখানা সন্দেশখালি….