একদম সত্যি কথাঃ স্নানযাত্রা ও চাঁপার কথা
তমাল সাহা

জগন্নাথের স্নানযাত্রার দিন যখন মান্ধারী বাজারে শিবমন্দিরে বসে স্নানযাত্রার বিষয়ে বলছিলাম, তখন কীর্তন নামগানে অংশ নেওয়া কয়েকজন কীর্তনিয়া নামগান শেষে আমার কাছে এসে বললেন, আপনি বেশ সুন্দর বললেন।

আসলে আমি এইসব তথাকথিত ধর্মীয় কাহিনীর মধ্যে লৌকিক জীবন মিশে থাকলে ভালোই বলতে পারি। আরো ভালো বলতে পারতাম তখন চাঁপার মুখটি বারবার ভেসে উঠছিল। তাই শব্দ প্রক্ষেপণের সময় একটু আবেগও আসছিল।

ওই যে মান্ধারী বাজার!প্রায় শতাব্দী প্রাচীন। এখানে বাজার বসতো। বাঁদিকে কুয়োতলা, ডান দিকে মান্ধারী পাঠশালা রেখে মাঝখানের রাস্তা দিয়ে রুমিদির বাড়ি যেতুম। শিবমন্দির ডান দিকে। গর্ভগৃহে শ্বেত পাথরের শিবলিঙ্গ। মন্দিরের বাইরে চাঁপা গাছে সে কী ঝাঁপিয়ে ফুলসজ্জা সে এক সময়! স্বর্ণচাঁপা। সাধারণভাবে আমরা বলি চাঁপা ফুল।

একদিন রুমিদিকে বলি, চাঁপাকে দেখলাম। রুমিদি বলে, চাঁপা আবার কে? তখন আমার বয়স ১৩ হবে। প্রেম-টেম করছিস নাকি? রুমিদির মুখটি একটু কেমন হয়ে গেল! একে কি মনমরা বলে? অন্য মেয়েদের কথা বললে সব মেয়েদেরই মুখ এমন হয় বলে আমার ধারণা।

উল্টোদিকে কথা ঘুরানোর জন্য বলি, রুমিদি এখানে শিবলিঙ্গ সাদা কেন? লিঙ্গ মানে কি?
রুমিদি বলে, শিব মানে মঙ্গলময়। সাদা হলো শুদ্ধতা আর লিঙ্গ অর্থ প্রতীক। শিব মানে শ ই ব। শ মানে সুখ, ই কথার মানে পুরুষ, ব মানে অমৃত। শব শব্দ থেকেও শিব আসতে পারে। নম মানে জানিস? ন মানে মাটি, ম মানে জল। লিঙ্গ কথাটির অর্থ হল সবকিছু লীন হয়ে যায় যেখানে, সেটাই লিঙ্গ। শিব লিঙ্গে দেখবি তিনটি সাদা দাগ থাকে। শিবের কপালেও এমন তিনটি দাগ থাকে। একে বলে ত্রিপুণ্ড্র।
আমি রুমিদের দিকে তাকিয়ে থাকি।

রুমিদি এবার বলে তোর চাঁপার কথা মনে হলো কেন? তুমি অমন করে বলছ কেন! নাগো, না! চাঁপা তো আমার সঙ্গে সতীশ নন্দী পাঠশালায় পড়তো। ওর তো বাবা নেই। শুনেছিলাম আত্মহত্যা করেছে। তখন চাঁপা খুব ছোট। বছর পাঁচেক হবে।
তো ওরা কোথায় থাকে?
ওয়ার্কশপ রোডে দেবেন দে-র মিষ্টির দোকানের পাশ দিয়ে ছোট্ট মতো গলির ভেতর একটা বাড়িতে। তা এখন ওদের চলে কি করে? ওর এক কাকা আছে। ওরা কাকার সঙ্গে থাকে। রুমিদির একটু শ্বাসপতন হলো যেন মনে হল। তবে বাবা মারা যাবার পর ওরা এখান থেকে দেবানন্দপুর চলে গেছে।।

তা আজ চাঁপার কথা বললি কেন? চাঁপার চিঠি এসেছে। আট দিন হলো ওর কাকা মারা গিয়েছে। ও লিখেছে, মা শুধু চুপচাপ বসে থাকে। মাঝে মাঝে আঁচল চাপা দিয়ে চোখ মোছে। আমি ভালো নেই। মা আছে। তবু একলা মনে হয়। জানো তো চাঁপার মাকে দেখতে খুব মিষ্টি। ওর মা ভালো রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে পারে।
কাকা মারা যাবার পর ওর মা স্নান সেরে কাকা এবার পুজোয় ওর মাকে যে শাড়িটা দিয়েছিল সেটি পরে ভেজা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গান গাইছিল, একলা পথে যেতে যেতে….

মন্দিরের পাশে শতাব্দী প্রাচীন স্বর্ণচাঁপা গাছটি এখনো আছে। গাছের পাতার ফাঁকে দু-চারটি ফুল দেখলাম এই প্রবীণ বেলায়।

প্রবীণা নারীবৃক্ষে ফুল ধারণের সময়কাল কত পর্যন্ত,কে জানে!